ডিজিটাল দুনিয়ায় যন্ত্র নির্ভরতার যুগে নানা জাগতিক হিসাব কি ওলটপালট করে দিতে পারে মহাজাগতিক শক্তি বা বলা ভাল, মহাজাগতিক বিকিরণ? আক্ষরিক অর্থেই বার বার এর সদর্থক উদাহরণ মিলেছে। ২০০৩ সালে তার নমুনাও পাওয়া গিয়েছিল।
সে বছর বেলজিয়ামের এক পুরসভার নির্বাচনে এক অখ্যাত প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটসংখ্যায় হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন অনেকেই। ভোটারসংখ্যা ছাপিয়ে ভোট পেয়েছিলেন ওই প্রার্থী। কী ভাবে এমন সম্ভব? ধাঁধা কাটিয়েছিল এক মহাজাগতিক কাণ্ড।
মধ্য ব্রাসেলসের স্কারবিক পুরসভার নির্বাচনে সে বার প্রার্থী ছিলেন মারিয়া ভিনডেভোগেল নামে এক অখ্যাত রাজনীতিক। বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে এবং নারীবাদের পক্ষে সরব ছিলেন তিনি।
রাজনীতির পণ্ডিতদের মতে, ব্রাসেলস-হ্যাল-ভিলভোর্দে নির্বাচনী জেলার প্রার্থী মারিয়ার জেতার কোনও আশাই ছিল না। তবে ভোটগণনার ফলাফল প্রকাশ্যে আসতে হতবাক হয়ে যান তাঁরা।
এ দেশের মতো ব্যালট বা ভোটযন্ত্রের বোতাম টিপে নয়, বেলজিয়ামের অনেকাংশে কম্পিউটারের মাধ্যমে ভোট দেন ভোটারেরা। সঙ্গে থাকে একটি ম্যাগনেটিক কার্ডও। তার মাধ্যমে চলে ভোটদান।
নিয়মানুযায়ী ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে হলে প্রত্যেক ভোটারকে একটি কম্পিউটারে ওই ম্যাগনেটিক কার্ডটি ঢোকাতে হয়। এর পর কম্পিটারের পর্দায় পছন্দসই প্রার্থীর নামের পাশে ‘ক্লিক’ করে তাঁকে ভোট দিতে হয়।
ভোটদানের দু’মুখী এই পদ্ধতিতে কম্পিউটারের সার্ভারের পাশাপাশি ওই ম্যাগনেটিক কার্ডেও সংশ্লিষ্ট ভোটারের পছন্দ নথিভুক্ত হয়ে যায়। কম্পিউটারে ভোটদানের পর ওই ম্যাগনেটিক কার্ডে একটি বাক্সে জমা করেন ভোটারেরা।
২০০৩ সালের ১৮ মে ব্রাসেলস-হ্যাল-ভিলভোর্দে নির্বাচনী কেন্দ্রের জন্য ভোটগ্রহণ করা হয়েছিল। ওই কেন্দ্রের চেম্বার অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ হওয়ার দৌড়ে থাকা প্রার্থীদের জন্য ৪,২৯৮ (০.৫১ শতাংশ) ভোট পড়েছিল। অন্য দিকে, লুভেন কেন্দ্রের জন্য সর্বোচ্চ ২,১৪২ (০.৬৭ শতাংশ) ভোট জমা পড়ে।
ভোটগণনার জন্য কম্পিউটার সার্ভারের তথ্য খতিয়ে দেখা যায়, মারিয়া পেয়েছেন ৪,৬১০ ভোট। অঙ্কের বিচারে এ হেন অসম্ভব কাণ্ড কী ভাবে ঘটল? গোড়ায় মনে করা হয়েছিল, ভোটে কারচুপি করা হয়েছে।
সদুত্তর খুঁজতে আরও এক বার ভোটগণনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ বার কম্পিউটার ঢোকানো ভোটারদের ম্যাগনেটিক কার্ড হাতে গোনা শুরু হয়।
এ বার দেখা যায় মারিয়ার পক্ষে পড়েছে ৫১৪টি ভোট। তবে কি ভোটগ্রহণের সময় কম্পিউটার সার্ভারে কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল?
উত্তর খুঁজতে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেয় বেলজিয়াম প্রশাসন। কম্পিউটার সার্ভারে কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়েনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পুনরায় ভোটগণনার পরেও মারিয়ার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা একই ছিল।
ভোটসংখ্যা খতিয়ে দেখে চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ্যে আসে। কম্পিউটারে প্রাপ্ত ৪,৬১০ ভোট থেকে মারিয়ায় আসল ভোট অর্থাৎ ৫১৪ বিয়োগ করে বার হয় ৪,০৯৬। যা ২ সংখ্যার ১২ গুণিতকের সমান (অর্থাৎ ২১২)।
কম্পিউটার বিশেষজ্ঞদের মনে হয়েছিল, মহাজাগতিক বিকিরণের জেরে এমন ফলাফল হতে পারে। কী সে জটিল অঙ্ক?
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মহাজাগতিক বিকিরণের জেরে সার্ভারে ‘বিট ফ্লিপ’ হওয়ায় মারিয়ার ভোটসংখ্যা ৪ হাজারের বেশি ছাড়িয়েছে। এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তাঁরা।
সহজ কথায় বলতে গেলে কম্পিউটারে যাবতীয় তথ্য ‘০’ এবং ‘১’, এই দুই সংখ্যায় অর্থাৎ ‘বিট’-এ ধরা পড়ে। কোনও সময়েই এর অন্যথা হয় না। একমাত্র মহাজাগতিক বিকিরণের জেরে সিঙ্গল-ইভেন্ট আপসেট (এসইইউ) ঘটলে ‘বিট’ উল্টে যেতে পারে।
বিজ্ঞানীরা জানান, মহাজাগতিক বিকিরণের মধ্যে মূলত প্রোটন এবং অন্যান্য পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের মতো শক্তিশালী কণা রয়েছে। যা সূর্য, সুপারনোভা এবং মহাজাগতিক রশ্মির মতো উৎস থেকে উদ্ভূত হয়।
এ ধরনের শক্তিশালী কণা যখন কম্পিউটার চিপ বা অন্যান্য বৈদ্যুতিন যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যায়, সেগুলি এতটাই শক্তি উৎপন্ন করে যাতে ‘আইয়োনাইজ় রেডিয়েশন’ হয়। ওই বিকিরণের জেরেই সেমিকন্ডাক্টরে বৈদ্যুতিন পরিবর্তন ঘটে। যার জেরে ভোল্টেজের ওঠানামা হয়। ঠিক যে ভাবে বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
ওই ধরনের বিকিরণের সময় ‘০’ এবং ‘১’ এই বিটগুলিতে বদল ঘটার সম্ভাবনাও তৈরি হয়। মারিয়ার পক্ষে ভোটগ্রহণের সময়ও হয়তো তা-ই হয়েছিল বলে বিজ্ঞানীদের দাবি। মহাজাগতিক বিকিরণের জেরে ‘০’ বদলে ‘১’ অথবা এর উল্টো হয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
অঙ্কের বিচারে ভোটগ্রহণের সময় কম্পিউটারের ১৩তম ‘বিট’-এ বদল হয়েছিল বলে দাবি। কারণ হিসাব কষে দেখা যায়, মারিয়ার প্রাপ্ত ভোট (৪,৬১০) থেকে আসল ভোট (৫১৪)-এর বিয়োগ করা সংখ্যাটি অর্থাৎ ৪,০৯৬ আসলে ২ সংখ্যার ১২ গুণিতক (অর্থাৎ ২১২)।