ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র সংগঠন হামাসের মধ্যে লড়াই আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। ইতিমধ্যেই দু’পক্ষের মোট ১,১০০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। মৃতদের মধ্যে রয়েছেন মহিলা এবং শিশুরাও।
শুক্রবার গভীর রাত থেকেই আকাশ, জল এবং স্থল— এই তিন পথেই ইজ়রায়েলে হামলা চালায় হামাস। পাল্টা জবাব দিয়েছে ইজ়রায়েলি সেনাও। ইজ়রায়েলি সেনা সূত্রে খবর, ২২টি জায়গায় হামাস জঙ্গিদের সঙ্গে ব্যাপক লড়াই চলছে তাদের।
হামাসের হাতে আমেরিকার বহু নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে, এমনটা দাবি করে ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জো বাইডেনের দেশ। রবিবার তারা জানিয়েছে, ভূমধ্যসাগরে রণতরী এবং যুদ্ধজাহাজ পাঠাচ্ছে তারা।
প্যালেস্তাইনের সঙ্গে ইজ়রায়েলের সংঘাতের ইতিহাস অবশ্য নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েল রাষ্ট্র গঠনের গোড়ার দিন থেকেই এই সংঘাত অশান্ত করে রেখেছে গোটা পশ্চিম এশিয়াকে।
এই সংঘাতের চরিত্রগুলি সময়ের সঙ্গে বদলেছে। কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধানসূত্র অধরাই থেকে গিয়েছে। বরং পশ্চিম এশিয়ার স্থানীয় সমস্যা থেকে এটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ক্রমশ জটিলও হয়েছে এই এলাকার ভূ-রাজনীতি।
যেমন চলতি এই সংঘাতের নেপথ্যে অনেকেই ইরানের হাত দেখছেন। পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির বড় অংশের দাবি, হামাসদের অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে ইরান। তাতে সঙ্গত দিচ্ছে কাতার।
জল্পনাকে সত্যি করে ইরানের মুখ্য ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের প্রধান সামরিক উপদেষ্টা জানিয়েছেন, ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের এই লড়াইকে সমর্থন করছে তেহরান।
কিন্তু কেন ইজ়রায়েল সঙ্কটে জড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের একাধিক শক্তিধর দেশ? চলতি সংঘাতের প্রেক্ষাপট খুঁজে বার করতে পৌঁছতে হবে ১৯১৮ সালে, যে সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্ক এবং সংলগ্ন এলাকা ব্রিটেনের দখলে আসে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইহুদি শরণার্থীদের জন্য স্থায়ী একটি দেশ গঠনের জন্য ১৯৪৮ সালে তৈরি হয় ইজ়রায়েল।
রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপে স্থির হয় যে, প্যালেস্টাইন ভেঙে তৈরি হবে ইজ়রায়েল। কিন্তু ইজ়রায়েল রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে আরব দেশগুলি।
সংঘাতের সূচনা হয় তার পরেই। জেরুজ়ালেমের অধিকার নিয়েও লড়াই হয় যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে। কারণ খ্রিস্ট, ইহুদি এবং ইসলাম— তিন ধর্মাবলম্বীদের কাছেই পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ ওই শহর।
সংঘাত যত বাড়তে থাকে, ততই তাল ঠুকতে থাকে ইহুদি এবং আরব জাতীয়তাবাদ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কার্যত দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো দেশগুলি অবশ্য বরাবর ইজ়রায়েলের পাশেই দাঁড়ায়।
দীর্ঘ দিন ই়জ়রায়েল এবং পশ্চিমি শক্তিগুলির সঙ্গে প্যালেস্তাইনের হয়ে দর কষাকষির কাজ করেছেন প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজ়েশন (পিএলও)-র প্রধান ইয়াসের আরাফত।
কিন্তু প্যালেস্তাইন সংঘাতের স্থায়ী সমাধানসূত্র অধরা থাকার কারণে ক্রমশ রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে আরাফতের।
এই অবস্থায় প্যালেস্তাইনের রাজনৈতিক মঞ্চে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে থাকে হামাস। সুন্নি মুসলিম সংগঠন ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর রাজনৈতিক শাখা হিসাবে ১৯৮৭ সালে আত্মপ্রকাশ করে হামাস।
গোড়ার দিন থেকেই ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হানা এনে খবরের শিরোনামে উঠে আসে হামাস। হামাসের বিরুদ্ধে চরমপন্থায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
কিন্তু শত সমালোচনা এবং বিতর্ক সত্ত্বেও ২০০৬ সালের প্যালেস্তাইন নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন পায় হামাস। যা থেকে বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক পরিসরে এই বার্তাই যায় যে, আরব জাতীয়তাবাদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে হামাস।
বর্তমানে হামাস জঙ্গিদের অস্ত্র লুট করা থেকে রুখতে গাজা সীমান্ত প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে ইজ়রায়েল এবং মিশর। চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় গাজ়ার মানুষদের খাদ্য এবং পানীয় সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হয়েছে।
ইজ়রায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তথা লিকুড দলের প্রধান বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু রক্ষণশীল রাজনীতিক হিসাবেই পরিচিত। মনে করা হয়, ঘরোয়া রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কারণেই তিনিও প্যালেস্তাইনের প্রতি কঠোর অবস্থান নিয়েই চলবেন।
তবে সম্প্রতি আমেরিকার মধ্যস্থতায় আরব জাতীয়তাবাদের শরিক সৌদি আরবের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল ইজ়রায়েল। বলা হয়েছিল, এ বার নয়া পশ্চিম এশিয়া তৈরি হবে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই সম্ভাবনা বিশ বাঁও জলে বলে মনে করা হচ্ছে। এ-ও মনে করা হচ্ছে, ইরানের মতো গোঁড়া এবং চরমপন্থী দেশগুলি নেতানিয়াহুর দেশের সঙ্গে এই বোঝাপড়ায় যেতে চাইছে না।
আক্রমণের ধরন দেখে অনেকেরই ধারণা আটঘাট বেঁধেই ইজ়রায়েলে হামলা চালিয়েছে হামাস। অন্য দিকে, রাষ্ট্রপুঞ্জে হামাসকে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণার দাবি তুলেছে ইজ়রায়েলও। তাই এই পুরনো সংঘাত আবার মাথাচাড়া দিয়েছে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই সংঘাতের পারিপার্শ্বিক ফল হিসাবে সোনা এবং গয়নার দামবৃদ্ধি এবং শেয়ার বাজারে টালমাটাল পরস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।