এ একেবারে বাস্তবের ‘ডলি কি ডোলি’র গল্প। সেই ফিল্মের সোনম কপূরই যেন এখানে নাম বদলে কখনও কাজল, তো কখনও সোনালি!
দিল্লির অঙ্কের শিক্ষক অজয় কুমার ভেবেছিলেন ২০২০ সালের ৭ অগস্ট জীবনের সেরা সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেছেন তিনি।
ঠিক ছ’মাস আগে কাজল গুপ্তের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। তার পর প্রেম, ঘনিষ্ঠতা, বিয়ের প্রস্তাব। এমনকি অগস্টের শুরুতে মন্দিরে গিয়ে বিয়েও। কাজল বাড়ির সব কাজ করতেন। নিজে সঞ্চয়ী তো ছিলেনই, অকারণ খরচ করতে দিতেন না অজয়কেও। প্রশ্ন করলে বলতেন, জমা থাক। বৃদ্ধ বয়সে কাজে লাগবে।
ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে একটু বেশি থাকতেন ঠিকই, তবে এটা-ওটা কিনে দেওয়ার আবদার ছিল না। কোনও চাহিদাও ছিল না। কাজল বলতেন, আদর্শ গৃহবধূ হওয়াই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। অনূর্ধ্ব ৩০-এর কাজলে মুগ্ধ ৩১-এর অজয় তখন প্রায়ই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতেন তাঁকে এমন জীবনসঙ্গিনী খুঁজে দেওয়ার জন্য। যদিও বছর ঘুরতে সেই ভুল ভাঙল।
এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে অজয় দেখলেন তাঁর বাড়ির আসবাব থেকে শুরু করে সঞ্চিত অর্থ সব উধাও। খোঁজ নেই স্ত্রীরও। অজয় ছিলেন ‘কাজল’-এর সপ্তম শিকার।
অজয়ের আগে তালিকায় রয়েছেন এক জন শেয়ার বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, আর্থিক লেনদেন বিশেষজ্ঞ, এমনকি এক ব্যবসায়ীও। যাঁদের প্রত্যেকেরই প্রথমে নেটমাধ্যমে ‘কাজল’-এর সঙ্গে যোগাযোগ, তার পর প্রেম, বিয়ে, একত্রবাস, এমনকি, মধুচন্দ্রিমাও। শেষে প্রত্যেকেরই সর্বস্ব নিয়ে হাওয়া হয়েছেন কাজল।
অনেক খুঁজেও লাভ হয়নি। ‘কাজল’কে তার কোনও স্বামীই শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাননি। যাতে না পান সেই ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনিই। ‘কাজল’কে খুঁজতে নেমে পুলিশ জেনেছে, তাঁর অন্তত ১২টি ভোটার কার্ড, ৯টি আধার কার্ড, ছ’টি প্যান কার্ড রয়েছে। যার সাহায্যে সহজেই আত্মগোপন করতে পারতেন তিনি।
প্রতারিত হওয়ার পর অজয় একে একে এই সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেছিলেন। দিল্লির অঙ্কের শিক্ষক যত তাঁর ‘স্ত্রী’কে জানছিলেন, ততই বুঝতে পারছিলেন, কত কম জেনে তিনি বিয়ে করেছিলেন। পাত্রীর আসল নামও জানতেন না তিনি। তবে অজয়ের ক্ষেত্রেও অজান্তে এই একই ভুল করেছিলেন তাঁর ‘স্ত্রী’ও।
‘কাজল’ও তাঁর ‘স্বামী’ বেছে নেওয়ার আগে জানতে পারেননি, তাঁর অঙ্কের শিক্ষক স্বামী এক জন শখের গোয়েন্দাও। অজয় যেমন কালো বোর্ডে তাঁর অঙ্কের উত্তর মেলান ঠিক তেমন করেই ধৈর্য ধরে রহস্যের হারিয়ে যাওয়া এক একটি টুকরো মেলাচ্ছিলেন তিনি।
অজয়ের সূত্র ধরেই পুলিশ জেনেছে শেষ বার গত ৩০ মে উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপুরে দেখা গিয়েছে ‘কাজল’কে। এখন অবশ্য তিনি সোনালি সিংহ। তাঁর অষ্টম স্বামীর সঙ্গে নৈনিতাল-দেহরাদূনে মধুচন্দ্রিমায় রয়েছেন তিনি।
উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদ হয়ে উত্তরাখণ্ডের নৈনিতালে গিয়েছিলেন সোনালি। খোঁজ পেয়ে নৈনিতালের হোটেলে ফোন করে অজয় জানতে পারেন, সোনালি তাঁর স্বামীর সঙ্গে সেখানে থাকছেন গত কয়েক দিন ধরেই। হোটেলের রিসেপশনিস্টই অজয়কে জানান, ‘‘স্যার এবং ম্যাডাম মধুচন্দ্রিমায় এসেছেন।’’
অজয় এখন জানেন এর পর কী হতে চলেছে। দেড় বছরের সম্পর্কে স্ত্রী-র সঙ্গে মধুচন্দ্রিমায় যাওয়া হয়নি তাঁর। কারণ, তাঁদের বিয়ে হয়েছিল লকডাউনের সময়। কিন্তু নিজের স্ত্রী-র প্রাক্তন স্বামীদের সঙ্গে কথা বলে অজয় জেনেছেন, প্রত্যেক বিয়েতেই মধুচন্দ্রিমা পর্ব সেরেছেন ‘কাজল’। তার পর প্রথমে আদর্শ গৃহবধূ হওয়ার নাটক এবং শেষে নিজের ব্যবসা শুরুর প্রস্তাব।
অজয়ের ক্ষেত্রে এই পর্ব শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের শুরুতে। অজয়কে কাজল বলেছিলেন তিনি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান। বুটিকের ব্যবসা খুলতে চান। দিল্লিতে সেই বুটিকের মূলধনে বিনিয়োগ করতে নিজের ১৫ লক্ষ টাকার সঞ্চয়ের পুরোটাই স্ত্রীকে দিয়ে দিয়েছিলেন অজয়। দরকার ছিল আরও ১৭ লক্ষ টাকার। সেই টাকা পাঁচটি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে স্ত্রীকে দেন অজয়। সেই ব্যাঙ্কগুলি এখনও ঋণের টাকা চেয়ে ফোন করে অজয়কে।
দিল্লির বল্লভগড়ে বাড়ি ছিল অজয়ের। সেখানেই তাঁর অঙ্কের কোচিং সেন্টার। ‘কাজল’ অবশ্য বুটিকের জন্য একটু দূরের জায়গা বেছে নেন। দিল্লির লক্ষ্মীনগরে বুটিকের দোকান নেন অজয়ের স্ত্রী। কয়েক মাস পরে দোকানের উপরেই দু’কামরার একটি ফ্ল্যাটে উঠে আসেন তাঁরা দু’জনেই। সেখান থেকেই নিয়মিত ৪৫ মিনিট দূরে বল্লভগড়ের কোচিং সেন্টারে যাতায়াত করতেন অজয়। ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার সময় বল্লভগড়ে পুরনো বাড়িতে থেকেও যেতেন অজয়। এমনই এক পরীক্ষার সময়ে দু’দিন পর লক্ষ্মীনগরের ফ্ল্যাটে এসে অজয় চমকে যান।
ফ্ল্যাটের জিনিসপত্রের পাশাপাশি দোকানের সমস্ত মালও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘কাজল’। প্রতিবেশীরা অজয়কে জানান তাঁর পরিবারের লোকজনই এসে নিয়ে গিয়েছে সে সব জিনিস। প্রশ্ন করলে ‘কাজল’ তাঁদের জানান, তাঁরা ফরিদাবাদ চলে যাচ্ছেন।
পুলিশকে অজয় জানিয়েছেন, স্ত্রীর বাবা-মায়ের সঙ্গে কখনও মুখোমুখি দেখা হয়নি তাঁর। বিয়ের আগে ফোনে কথা হয়েছে। ‘কাজল’ তাঁকে জানিয়েছিলেন, তাঁর বাবা-মা শহরের অন্য প্রান্তে থাকেন। তবে নিজের আত্মীয় বলে বিভিন্ন সময়ে ১১ জনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অজয়ের। পুলিশের ধারণা, ১১ জনের এই দলটি ‘কাজল’ ওরফে ‘সোনাল’-এর ভাড়া করা।
কাজল এখনও অধরা। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী তাঁর প্রতারণবৃত্তি পুরোদমে চলছে এখনও। তবে পুলিশ তাঁর ১২টি পরিচয়পত্রের জাল সরিয়ে অজয়ের সাহায্যে আসল পরিচয় কিছুটা জেনে ফেলেছে।
১৯৯০-’৯৪ সালের মধ্যে লুধিয়ানায় জন্ম ‘কাজল’-এর। তাঁর ‘প্রিয় বন্ধু’ অঞ্জলি জানিয়েছেন, ছোট থেকেই মডেল হতে চাওয়া ‘কাজল’ কেনাকাটি করতে ভালবাসতেন। আকছার পরিচিতদের থেকে অর্থ ধার করতেন। তবে টাকা ফেরত দেওয়ার অভ্যাস কোনও কালেই ছিল না ‘কাজল’-এর।
২০১৮ সালে অঞ্জলির সঙ্গে আলাপ ‘কাজল’-এর। অজয়কে তিনি জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকাকালীনই ছ’জনকে বিয়ে করে প্রতারণা করেন ‘কাজল’। এ ভাবে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে বিদেশে চলে যাওয়ার পরিকল্পনার কথাও অঞ্জলিকে বলেছিলেন কাজল।
অজয়ের সঙ্গে অঞ্জলির আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন ‘কাজল’ই। সম্ভবত সেটা ছিল ‘কাজল’-এর দ্বিতীয় ভুল। কারণ স্ত্রীর খোঁজে নেমে অজয় যখন একে একে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়া ‘কাজল’-এর আত্মীয়দের খোঁজ করছেন তখনই অঞ্জলির খোঁজ পান অজয়। পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে জেনে নেন ‘কাজল’ সম্পর্কে না-জানা তথ্য। এর পরের তদন্ত-পর্ব এগোয় টানটান গোয়েন্দা গল্পের মতোই।
প্রথমে অন্য নামে নেটমাধ্যমের একটি অ্যাপে নিজের একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন অজয়। ওই অ্যাপেই স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তাঁর। তার পর খুঁজে পান স্ত্রীকেও। সোনালি নামে একটি নতুন অ্যাকাউন্টে। অ্যাপে সোনালির ছবি ভিডিয়োয় নিয়মিত নজর রেখেই অজয় ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন তাঁর গতিবিধি।
একে একে সমস্ত তথ্য, প্রমাণ সংগ্রহ করে পুলিশের হাতে তুলে দেন অজয়। কিন্তু ‘কাজল’ এখনও অধরাই।
পুলিশ জানিয়েছে, তাঁদের হাতে যে তথ্য রয়েছে, তাতে ওই প্রতারণা চক্রকে ধরা শুধু সময়ের অপেক্ষা। যদিও গত ৩০ মে-র পর অষ্টম স্বামীর সঙ্গে মধুচন্দ্রিমা সেরে ‘কাজল’ আপাতত কোথায়, তার সদুত্তর পাওয়া যায়নি।