ছবির মতো সাজানো-গোছানো বিলাসবহুল ভিলা। তাতে একে একে প্রবেশ ঘটে হবু যুগলদের। ক্যামেরার সামনেই চলে তাঁদের ডেটিং পর্ব। মন দেওয়া-নেওয়ার পালা শেষে নিজেদের জীবনসঙ্গী বেছে নেন যুগলেরা। সঙ্গে জোটে বিপুল অর্থমূল্যের পুরস্কারও।
ব্রিটিশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় ডেটিং রিয়্যালিটি শো ‘লভ আইল্যান্ড’-এর দৌলতে দক্ষিণ আফ্রিকার এই ভিলার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ওই শোয়ের প্রতিযোগীরাই এখানে নানা খেলায় মেতে ওঠেন। শোয়ের নামেই এটি ‘লভ আইল্যান্ড ভিলা’ বলে পরিচিতি পেয়েছে।
কেপ টাউনের অদূরে লভ আইল্যান্ড ভিলার অন্দরের মতো সেখান থেকে বাইরে তাকালেও চোখ জুড়িয়ে যায়। যে দিকে নজর যায়, সার সার আঙুরের ক্ষেত। স্থানীয় নির্মাতারা সেখান থেকেই ওয়াইন তৈরির রসদ পান। তবে অন্দর বা বাইরের দৃশ্য যতই মনোরম হোক না কেন, ভিলার আশপাশ সাক্ষী থেকেছে হাড়হিম করা বহু খুনের।
লুডাস ম্যাগনাস এস্টেটের প্রায় ২৫ একর ব্যাপী ভিলার আশপাশে ঘটেছে একাধিক অপরাধ। তার কোনওটি আজও রহস্যেমোড়া। কোনওটিতে আবার অপরাধীরা ধরা পড়েছে। পথদুর্ঘটনায়ও প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে।
লভ আইল্যান্ড ভিলায় রয়েছে ১৭টি বেডরুম, ট্রিহাউস, অলিম্পিকের সাঁতারুদের মতো যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা যুক্ত সুইমিং পুল, রানিং ট্র্যাক-সহ আমোদপ্রমোদের নানা উপকরণ। আকাশের গায়ে ভেসে বেড়ানোর বন্দোবস্তও রয়েছে এতে। বিদ্যুতের তারের মতো কয়েকটি তারে হুকের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ঝুলে পড়তেও পারেন এই রিয়্যালিটি শোয়ের প্রতিযোগীরা।
ব্রিটিশ টিভিতে ৯টি মরসুম কাটিয়ে ফেলেছে ‘লভ আইল্যান্ড’। চলতি মাসের ১৬ তারিখ থেকে শোয়ের নতুন মরসুম শুরু হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের দাবি, নতুন মরসুমের জন্য ভিলাটি সাজাতে ইতিমধ্যেই ১২ লক্ষ পাউন্ড (ভারতীয় মুদ্রায় ১২ কোটি টাকার বেশি) খরচ করে ফেলেছেন প্রযোজকেরা।
‘লভ আইল্যান্ড’-এর প্রতিযোগীরা ভিলায় নিজেদের খেলাও শুরু করে দিয়েছেন। নানা পর্বের বাধা পেরিয়ে শেষমেশ তাঁদের জীবনসঙ্গী খুঁজে নিতে হবে। বিজেতারা পাবেন ৫০ লক্ষ টাকারও বেশি পুরস্কার।
ফ্র্যান্চেক এলাকায় এই ভিলার অন্দরের ঝাঁ-চকচকে চেহারায় ভুলবেন না যেন। এর আশপাশে বহু অপরাধে গা ছমছম করে অনেকের। বছর চারেক আগেকার একটি খুনের কথাই ধরা যাক।
২০১৯ সালের অগস্টে ফ্র্যান্চেক এলাকায় ডেভিড হফম্যান নামে এক পুলিশ সার্জেন্টকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। সেটি দুর্ঘটনা না খুন, তা নিয়ে আজও রহস্য রয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়েস্টার্ন কেপ এলাকায় বিভিন্ন গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে খ্যাতি পেয়েছিলেন ৪০ বছরের হফম্যান। ঘটনার দিন এলাকার একটি বাড়িতে গিয়েছিলেন হফম্যান। সে সময় ডিউটিতে ছিলেন না তিনি।
ফ্র্যান্চেক এলাকায় ওই বাড়িতে হফম্যান ঢোকার পর ওই বাড়িতেই নাকি ঢুকে পড়েন স্থানীয়েরা। অভিযোগ, তাঁদের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল হফম্যানের। সে সময়কার মতো স্থানীয়েরা চলে যান। এর পর হফম্যানের দেহ পাওয়া যায়। কে বা কারা খুন করল তাঁকে?
হফম্যানের খুনের পর তা নিয়ে নানা জল্পনা ছড়িয়েছিল। দুর্ঘটানবশত গুলিচালনায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। অভিযোগ, পুলিশি কাজে হফম্যানের সঙ্গী ডিটেকটিভ মার্লোন অ্যাপোলিসের হাত থেকেই গুলিটি বেরিয়ে যায়। পরে মার্লোনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগে মামলা রুজু করা হয়েছিল।
হফম্যানের ঘটনায় শিরোনামে উঠে এসেছিল তাঁর দাম্পত্যজীবনের কথাও। প্রয়াত স্বামী তাঁকে কী ভাবে আগলে রাখতেন, তার উদাহরণ দিয়েছেন হফম্যানের স্ত্রী অ্যাশলে। তিনি জানিয়েছিলেন, ৯ বছর বয়সে স্কুলের প্রথম দিন থেকে তাঁর সঙ্গী ছিলেন হফম্যান।
শেষকৃত্যের দিন প্রয়াত স্বামীর স্মরণে নিজের ভাষণে অ্যাশলে একটি ঘটনার কথা তুলে ধরেছিলেন। স্কুলের প্রথম দিন ক্লাসঘরে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিলেন অ্যাশলে। তা নিয়ে গোটা ক্লাসে তামাশার পাত্রী হলেও মেঝে মোছার জন্য মপ আর বাস্কেট নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন হফম্যান। অ্যাশলের কথায়, ‘‘ওই দিন থেকে আমার রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠে ও। আমাকে আগলে রাখত হফম্যান। সব সময় বলত, চিন্তা কোরো না।’’
হফম্যানের হত্যারহস্যের আজও কিনারা হয়নি। এমনই আর একটি খুনের ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল লভ আইল্যান্ড ভিলার আশপাশ।
বিয়ের বছরখানেকের মধ্যেই খুন হয়েছিলেন শানেল দুতোয়েত নামে ১৮ বছরের এক তরুণী। ২০১০ সালের জুলাই মাসের ওই ঘটনার পর এক দশকের বেশি কেটে গেলেও তা নিয়ে স্থানীয়দের আলোচনা থামেনি।
সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, ফ্র্যান্চেক এলাকায় স্বামী ইয়োহানকে নিয়ে স্বপ্নের জগৎ গড়েছিলেন শানেল। ইয়োহান ছিলেন স্থানীয় একটি ফার্মের সহকারি ম্যানেজার।
বিয়ের এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই খুন হয়েছিলেন শালেন। শোয়ার ঘরে তাঁর নগ্ন দেহ দেখতে পান ইয়োহানের মা। শানেলের হাতের নখে কারও চামড়া আটকে ছিল। তদন্তকারীদের অনুমান ছিল, হত্যাকারীকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাধা দিতে চেয়েছিলেন শানেল। তবে তাঁকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছিল।
তদন্তকারীদের কাছে ইয়োহানের দাবি ছিল, ঘটনার সময় শিকারে বেরিয়েছিলেন তিনি। তবে পরে তাঁকে স্ত্রীকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
কাকতালীয় ভাবে, এই মামলার শুনানি শুরু হতেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকে। প্রথমে দীর্ঘ দিনের অসুস্থতায় বিচারকের মৃত্যু হয়। পরে নানা কারণে মামলার শুনানি ব্যাহত হয়।
তদন্তকারীদের দাবি, অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন বিবাহিত ইয়োহান। সে কারণেই শানেলকে খুন করেছিলেন তিনি। যদিও এ নিয়ে আদালতে প্রমাণ দিতে পারেননি তাঁরা। ইয়োহানও নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছিলেন। আজও এই মামলার রহস্যভেদ হয়নি।
ফ্র্যান্চেক পাস এলাকায় ২৩ বছর আগেকার একটি খুনের রহস্য অবশ্য ভেদ করতে পেরেছিলেন তদন্তকারীরা। ২০০০ সালে ২৫ বছরের ডোরিয়ান ফান রেনসবার্গ এবং তাঁর ২১ বছরের বান্ধবী মারিয়া এলিজ়াবেথ দু তোয়েতকে গুলি করে খুন করা হয়েছিল।
ঘটনার দিন ফ্র্যান্চেক পাস এলাকায় এক বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলে ডোরিয়ান এবং মারিয়া। ওই হামলায় বেঁচে যান তাঁদের বন্ধু। পুলিশের কাছে মারিয়াদের ওই বন্ধুর দাবি ছিল, ফোক্সভাগেন গাড়ি, মোবাইল এবং টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ডোরিয়ানের মাথায় গুলি করেছিল দুষ্কৃতীরা।
এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন মর্নে ল্যাকে নামে ২৩ বছরের এক যুবক, তাঁর সঙ্গী ডাওইড উইলিয়ামাস, হাইনরিকো পিটারসেন এবং ইয়েহান আব্রাহামস। খুন, খুনের চেষ্টা এবং সশস্ত্র ডাকাতির জন্য প্রত্যেককেই ৩০ বছরের কারাবাসের সাজা দেয় আদালত।
আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে দুঃখপ্রকাশ করে মর্নে বলেছিলেন, ‘‘ডোরিয়ানের থেকে ওঁর গাড়ির চাবি চেয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, গাড়ির ভিতরে চাবি রয়েছে। এর পর তাঁর টাকার ব্যাগ দিয়ে দেন। আমি কিছু টাকা বার করে ব্যাগটা ফেলে দিয়েছিলাম। সে সময় আমরা ডাকাতি করতে চেয়েছিলাম। তবে ডোরিয়ান ছটফট করতে থাকায় ওঁর মাথায় গুলি করি।’’
মামলা চলাকালীন জেলপালানো ছাড়াও নানা অপরাধে মর্নে, উইলিয়ামাস, আব্রাহামস এবং পিটারসেনকে যথাক্রমে আরও ৪১, ৩৫, ৩০ এবং ৩৬ বছরের বছরের কারাবাসের সাজা দেয় আদালত। ৪ জন বোধ হয় কখনই জেল ছেড়ে বেরোতে পারবেন না।