‘ধর্মঘট’ শব্দের সঙ্গে কলকাতাবাসীর সম্পর্ক গভীর। কিন্তু জানেন কি তিলোত্তমা প্রথম কবে ধর্মঘট দেখেছিল? আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে। সেই হরতাল ডেকেছিলেন পালকিবাহকেরা। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে।
কলকাতায় পালকি চলাচলের ইতিহাস বহু প্রাচীন। ব্রিটিশ আমলেও পালকি ছিল যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বাঙালি বাবু থেকে ইয়োরোপীয় গোরা সাহেব। পালকি বাহন ছিল দুই তরফেই। তাঁদের পালকি যাঁরা বহন করতেন, তাঁদের মধ্যে বাঙালিদের পাশাপাশি ছিলেন ভিন্ রাজ্যের মানুষও।
ব্যক্তিগত মালিকানার পালকির পাশাপাশি ছিল ঠিকা বা ভাড়া করা বাহনও। তাঁদের বাহকরা আচমকাই বিপত্তির মুখে পড়লেন। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার পুলিশ বিভাগ ফরমান জারি করল, এ বার থেকে সব ঠিক পালকির রেজিস্ট্রি করাতে হবে।
পাশাপাশি বেহারাদের জন্য ধার্য হল লাইসেন্স নম্বর। পিতলের চাকতিতে খোদাই করা থাকবে নির্দিষ্ট নম্বর। পালকি চালানোর সময় বেহারাদের তাবিজের মতো সেটি পরতে হবে বাহুতে।
এই সিদ্ধান্ত মোটেও ভাল ভাবে নিলেন না পালকি বেহারাদের দল। এমনিতেই তাঁদের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য ছিল যথেষ্ট। তার উপর, যৎসামান্য পারিশ্রমিক নিয়েও উষ্মা ছিল। ওড়িশা থেকে আসা বেহারাদের দল কিছুতেই সেই পিতলের টিকিট পরতে রাজি হলেন না।
শ্রীপান্থ তাঁর ‘কলকাতা’ বইয়ে লিখছেন, বিক্ষুব্ধ পালকি বেহারাদের দল বৈঠকে বসলেন। তৈরি হল তাঁদের সংগ্রাম পরিষদ। সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হল, তাঁরা হরতাল ডাকবেন। যত দিন না অবধি টিকিট-সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তত দিন অবধি তাঁরা পালকি স্পর্শ করবেন না বলে ঠিক করলেন। যদি কোনও বাহক পরিষদের সিদ্ধান্ত না মানেন, তাঁকে একঘরে করার কথাও বলা হল।
২১ মে দুপুরবেলা প্রায় ১ হাজার পালকি বেহারা মিছিল করে গেলেন লালবাজার অবধি। তাঁদের প্রতিবাদ, ওজর আপত্তি কিন্তু ধোপে টিকল না। পুলিশ এই আইন প্রত্যাহারে রাজি হল না।
এর মাশুল কিন্তু দিতে হল কলকাতাবাসীকে। পরের দিন কোনও ঠিকা পালকি বাহক কাজে এলেন না। অচল হয়ে পড়ে রইল চতুর্দোলার সারি। বাবুদের অফিসকাছারি থেকে গিন্নিদের গঙ্গাস্নান— সব শিকেয় উঠল।
লাগাতার পালকি ধর্মঘটে কলকাতার নাগরিক জীবন প্রায় স্তব্ধ হতে বসল। শেষে অচলাবস্থা কাটাতে উদ্যোগী হলেন ব্রাউনলো নামে এক ইউরোপীয়। শহরে পরিত্যক্ত জুড়িগাড়ির চাকার অভাব ছিল না। সেখান থেকে চাকা নিয়ে সাহেব বসালেন নিজের পালকিতে। বেহারার বদলে সে পালকি টেনে নিয়ে গেল ছোট্ট আরবি ঘোড়া।
কিন্তু এই সঙ্কর বাহন তো বিশুদ্ধ পালকি নয়। আবার খাঁটি গাড়িও নয়। লোকের মুখে এর নাম হল ‘পালকি-গাড়ি’। কেউ কেউ বলতেন, ‘ব্রাউনবেরি গাড়ি’। শেষে ধর্মঘটী বেহারার দল কাজে ফিরলেন। কিন্তু তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। পালকির জায়গা নিয়ে নিয়েছে জুড়িগাড়ি।
তার পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গিয়েছে কলকাতার গতি-মানচিত্র। বহু বার পরিবহণ ধর্মঘটের সাক্ষী থেকেছে এ শহর। ইতিহাসের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছেন দু’শতক আগের পালকি বেহারার দল। চাপা পড়ে গিয়েছে তাঁদের করা প্রথম পরিবহণ ধর্মঘটও।