অফিসপা়ড়ার সব রাস্তার ব্যস্ততার সঙ্গে এই রাস্তাটার তুলনা হয় না। রাজভবনের কাছে যেন চুপিচুপি বসে রয়েছে এই গলিটা। রাস্তার পোশাকি নাম ‘ফ্যান্সি লেন’। কিন্তু এর সঙ্গে শখ শৌখিনতার কোনও সম্পর্কই নেই! এই ‘ফ্যান্সি’ কথাটা এসেছে ‘ফাঁসি’ শব্দ থেকে।
কী করে এমন নাম হল? লুকিয়ে রয়েছে ভয়ঙ্কর ইতিহাস। কলকাতায় ব্রিটিশ শাসনের গোড়ার দিকে যথেচ্ছ ফাঁসি দেওয়া হত। লঘু অপরাধও নিস্তার পায়নি ফাঁসি থেকে। মধ্যযুগীয় রীতি অনুসরণ করে এই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত প্রকাশ্যে, সকলের চোখের সামনে। এমনকি, মৃত্যুর পরে সেই নিথর দেহ ঝুলিয়ে রাখা হত। যাতে সাধারণ মানুষ টের পায়, কাকে বলে ‘সমুচিত শিক্ষা’।
ঘাঁটি করার পরে জোব চার্নক বুঝতে পারলেন, হুগলি নদীর তিরে নতুন এই জায়গায় ব্যবসার পথে প্রধান বাধা লুঠরাজ। ঠগী, বর্গি-সহ বিভিন্ন ধরনের দস্যুহানায় তখন সুতানটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা ছিল বিধ্বস্ত। বর্গি আক্রমণ আটকাতে স্থানীয় জমিদাররাও সাহায্য করেছিলেন ব্রিটিশদের।
শ্রীপান্থের ‘কলকাতা’ বইয়ের বর্ণনা বলছে, শুধু দস্যুবৃত্তিই নয়, ছোটখাটো চুরি ছিনতাই বা রাহাজানিতেও প্রাণদণ্ডের নিদান দেওয়া হত সে সময়ো। কোম্পানির লোক রীতিমতো ঢেঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করত অমুক দিন তমুকের ফাঁসি হবে। নথি বলছে, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফাঁসি হয়েছিল জনৈক ব্রজমোহনের।
ব্রজমোহনের ‘অপরাধ’ ছিল ঘড়ি চুরি। সে যুগের বাজারে চুরি করা ঘড়িটির দাম ছিল ২৫ টাকা। কলকাতার যে পথে লম্বা গাছ বেশি ছিল, তাকেই ফাঁসির মঞ্চ হিসেবে বেছে নিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা। ফাঁসির পাশাপাশি ‘শাস্তি’ ছিল তুড়ুম ঠোকা বা তোপের মুখে উড়িয়ে দেওয়া।
নন্দকুমারের ফাঁসি ছিল সে যুগের সবচেয়ে বিতর্কিত ও আলোচিত ঘটনা। গবেষকদের একাংশের মত, হেস্টিংসের চক্রান্তে দোষী প্রতিপন্ন হয়েছিলেন নন্দকুমার। ফোর্ট উইলিয়ামে ‘সুপ্রিম কোর্ট অব জুডিকেচার’-এর প্রথম প্রধান বিচারপতি এলাইজা ইম্পেও রায়দানের সময় বন্ধু হেস্টিংসের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছিলেন বলে অভিযোগ।
তার সঙ্গে অবিচার হলেও নন্দকুমারের প্রতিপত্তি ছিল। তিনি আইনি লড়াইয়ে অনেক দূর এগিয়েছিলেন। পাশে পেয়েছিলেন সমব্যথীদের। কিন্তু সাধারণ মানুষের কপালে তো সেটুকুও জুটত না। জমিদারের বিচারে তাদের ফাঁসির হুকুম শুনিয়ে দেওয়া হত। উনিশ শতকে পেশাদারি ওকালতি শুরু হওয়ার পরেও তা ছিল অত্যন্ত মহার্ঘ। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে সুবিচার অধরাই রয়ে গিয়েছিল।
জটিল ও অর্থবহুল বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যে না ঢুকে ছাপোষা মানুষের মনে হত এর থেকে বোধহয় মৃত্যুই ভাল। ব্রিটিশ হুকুমে দিনের আলোয় প্রকাশ্যে তাঁদের ফাঁসি দেখতে ভিড় করতেন বহু মানুষ। তা দেখে কেউ চোখ মুছতেন। আবার কেউ ব্রিটিশ ‘সুশাসনের’ ধন্যি ধন্যিও করতেন।
পুরনো কলকাতা নিয়ে লেখায় শ্রীপান্থ বলছেন, মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি দেখে সকলে ফিরেছিলেন গঙ্গাস্নান করে। কারণ নন্দকুমার ছিলেন ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মহত্যা দেখার মহাপাপ ধুয়ে ফেলতে গঙ্গাস্নানই ছিল সামাজিক বিধান। তবে সাধারণ অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট যে রাস্তা ছিল, সেখানে মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়া হয়নি।
১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রিম কোর্ট শুরু হওয়ার আগে প্রচিলত বিচারব্যবস্থায় সবচেয়ে নীচে ছিল জমিদারের বিচার। তবে এখানে ‘জমিদার’ বলা হত ইংরেজ সিভিলিয়ানদেরই। তাঁকে সাহায্য করার জন্য থাকতেন একজন ‘ব্ল্যাক জমিদার’। তখন এই প্রেক্ষিতে ‘ব্ল্যাক’ বিশেষণটা অপমানজনক ছিল না। বরং, প্রভাব প্রতিপত্তিশীল দেশীয় বিত্তবানকেই এই পদমর্যাদা দেওয়া হত।
এই ‘জামিদারের সালিশি’ সভায় ফাঁসির আদেশ দেওয়া হত সাধারণ মানুষকে। অসহায় মুখগুলির আইনি লড়াইয়ের দৌড় এখানেই শেষ হয়ে যেত। তারপর নির্দিষ্ট দিনে তাদের ফাঁসি দেওয়া হত নির্দিষ্ট রাজপথের ধারে লম্বা গাছগুলিতে। ব্রিটিশরা ‘ফাঁসি’ বলতে পারত না। তাই তাঁদের উচ্চারণে ওই মৃত্যুপথের নাম হয়ে গেল ‘ফ্যান্সি লেন’।
সে কালের সাবেক ফ্যান্সি লেনের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছিল একটি খাল বা সরু নদী। তার নাম ছিল ‘হেস্টিংস নদী’। এখন সেই নদীর জায়গায় বিছিয়ে আছে স্ট্র্যান্ড রোড এবং গভর্নমেন্ট প্লেস ওয়েস্টের সংযোগকারী কিরণশঙ্কর রায় রোড। এই পথের অতীতে হেস্টিংস নদীর পাশে ছিল লম্বা গাছ। সেখানেই ঝুলিয়ে রাখা হত দোষী সাব্যস্তদের।
তবে শুধু উঁচু গাছই নয়। ফ্যান্সি লেনে তৈরি হয়েছিল ফাঁসির মঞ্চও। এখন যেখানে ওল্ড কাউন্সিল হাউজ স্ট্রিট, সেখানেই তৈরি হয়েছিল ফাঁসিকাঠ। এর পর ফাঁসির সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছিল।
এখন সেই উঁচু গাছগুলি নেই। নেই হেস্টিংস নদীও। শুধু ফ্যান্সি লেন সাক্ষী রয়ে গিয়েছে অসংখ্য মৃত্যুর। (ঋণস্বীকার: কলকাতা: শ্রীপান্থ, কলিকাতার রাজপথ সমাজে ও সংস্কৃতিতে: অজিতকুমার বসু, মিউনিসিপ্যাল ক্যালকাটা: ইটস ইনস্টিটিউট ইন দেয়ার অরিজিন অ্যান্ড গ্রোথ) (ছবি: আর্কাইভ, শাটারস্টক এবং সোশ্যাল মিডিয়া)