রবিবার সকাল থেকেই আকাশে কালো মেঘ। দফায় দফায় মুষলধারে বৃষ্টি। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দাপট বাড়তে থাকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের। রবিবার রাত থেকে সমুদ্র আরও উত্তাল হয়ে যায়। প্রবল বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়াকে সঙ্গী করে কোথায় আছড়ে পড়েছিল রেমাল? কেমন ছিল তার গতিপ্রকৃতি? রেমাল শব্দের অর্থই বা কী?
রেমাল নামটি ওমানের দেওয়া। আরবি ভাষায় এই শব্দের অর্থ ‘বালি’। রেমালের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার। সাময়িক সর্বোচ্চ বেগ ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার।
রেমাল প্রথম নয়। এর আগেও বার বার ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ। ২০০৯ সালের ২৫ মে ১২০ কিলোমিটার বেগে রাজ্যে আছড়ে পড়েছিল আয়লা।
আয়লার প্রায় দশ বছর পর আবার ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয় রাজ্য। ২০১৯ সালের ৩ মে ঘণ্টায় ১৭৫ থেকে ১৮০ কিলোমিটার বেগে পশ্চিমবঙ্গের বুকে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল।
২০২০ সালের ২০ মে ঘণ্টায় ১৭৫ কিলোমিটার বেগে পশ্চিমবঙ্গে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় আমপান। এর প্রভাবে প্রবল ক্ষয়ক্ষতি হয় উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে।
আমপান-রোষের এক বছরের মাথায় ২০২১ সালের ২৬ মে ঘণ্টায় ১৫৫ কিলোমিটার বেগে পশ্চিমবঙ্গে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। ইয়াস বিদায়ের প্রায় তিন বছর পর রেমাল আবার তাণ্ডব চালাল বাংলায়।
সোমবার সকালে ঝড়ের মাত্রা কমলেও কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে সোমবার সকাল থেকে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হয়ে চলেছে। রাস্তাঘাটে জমে গিয়েছে হাঁটুজল।
কলকাতা শহর জুড়ে নানা জায়গায় গাছ পড়েছে। রাজভবনের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের কর্মীরা সেই গাছগুলি সরানোর ব্যবস্থা করেছেন। কলকাতার কোথাও কোথাও রবিবার মধ্যরাত থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই।
ব্যাহত হয়েছে ট্রেন এবং মেট্রো পরিষেবা। রবিবার দুপুর ১২ টা থেকে কলকাতা বিমানবন্দরে বিমান পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছিল। সোমবার সকাল ১০টা নাগাদ প্রায় ২১ ঘণ্টা পর আবার বিমান ওঠানামার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের জেরে কলকাতায় ঘণ্টায় ৭৪ কিলোমিটার বেগে বইল ঝোড়ো হাওয়া। আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলায় নবান্নে বিশেষ কন্ট্রোল রুম খুলেছিল রাজ্য প্রশাসন।
ঘূর্ণিঝড় রেমাল মোকাবিলায় কী কী প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিকদের কাছে রবিবার সন্ধ্যায় বৈঠকে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
আবহাওয়া দফতরের তরফে রবিবার বিকেলের পূর্বাভাস ছিল, উত্তর বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে যাবে রেমাল। রেমালের অবস্থান তখন পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপের ১৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ছিল। ক্যানিংয়ের ১৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্বে ছিল রেমাল। বাংলাদেশের মোংলা থেকে ১৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং বাংলাদেশের খেপুপাড়ার ১৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান ছিল ঘূর্ণিঝড়ের।
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের উপ অধিকর্তা সোমনাথ দত্ত জানিয়েছিলেন, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় রবিবার রাতে ঝড়ের গতিবেগ পৌঁছবে ১০০-১১০ কিলোমিটার পর্যন্ত। অন্য দিকে, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি এবং পূর্ব মেদিনীপুরে ঝড়ের গতি থাকবে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। তবে তা বেড়ে ৯০ কিলেমিটারও হতে পারে বলে সতর্ক করেছিল হাওয়া অফিস।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উত্তাল হয়ে পড়ে সমুদ্র। ঢেউয়ের উচ্চতাও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়। সেই কারণে মৎস্যজীবীদের সোমবার পর্যন্ত সমুদ্রে যেতে বারণ করেছে আলিপুর হাওয়া অফিস।
রবিবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ উত্তর বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে যায় রেমাল। রেমাল তখন পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপের ১৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে, ক্যানিংয়ের ১৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্বে, বাংলাদেশের মোংলা থেকে ২২০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং বাংলাদেশের খেপুপাড়ার ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান।
আবহাওয়া দফতরের রবিবার রাত সওয়া ৮টার পূর্বাভাস ছিল, উত্তর বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে যাবে রেমাল। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপের ১২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে, ক্যানিংয়ের ১৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্বে, বাংলাদেশের মোংলা থেকে ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং বাংলাদেশের খেপুপাড়ার ১৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল তার অবস্থান।
সাগরে শক্তি বাড়িয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে রবিবার রাত ১২টা নাগাদ ঘূর্ণিঝড় রেমালের ‘চোখ’ ঢুকে পড়ে স্থলভাগে। বাংলাদেশের খেপুপাড়া এবং পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপের মাঝখান দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করে প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসাবে বাংলাদেশের মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিমে আছড়ে পড়ে রেমাল। ঘূর্ণিঝড়ের ‘লেজটি’ ক্যানিং থেকে এখনও ৯০ কিলোমিটার দূরে ছিল। ল্যান্ডফলের গোটা প্রক্রিয়াটি প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলে। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানায়, রাত ১২টা নাগাদ রেমালের ল্যান্ডফল শেষ হয়।
নদিয়া এবং পূর্ব বর্ধমানে ঝড়ের গতি ৬০-৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছিল বলে হাওয়া অফিস সূত্রে খবর। তবে এই গতি বেড়ে ৮০ কিলোমিটার পর্যন্তও ছুঁয়েছে। এ ছাড়া দক্ষিণের বাকি জেলাগুলিতেও ৫০-৬০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া বয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতা, পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলিতে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হয়। রবিবার রাতে বৃষ্টির কারণে জেলাগুলিতে লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছিল।
সোমবার সকালে রেমাল তার দাপট কমিয়ে সাধারণ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হলেও সোমবার নদিয়া, মুর্শিদাবাদে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সেই জেলাগুলিতে জারি করা হয়েছে লাল সতর্কতা। কলকাতা, হাওড়া, দুই ২৪ পরগনা, হুগলি, বীরভূম এবং পূর্ব বর্ধমানে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির জন্য কমলা সতর্কতা জারি করা হয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের বাকি জেলাতেও ভারী বৃষ্টির জন্য হলুদ সতর্কতা জারি।