‘ছবিনির্মাতাদের মৃত্যু হয়, কিন্তু তাঁদের ছবির নয়।’ ইনস্টাগ্রামের বায়োতে নিজের নামপরিচয় দেওয়ার জায়গায় এমনটাই লেখা। সিনেমার প্রতি যাঁর এত ভালবাসা, ছবি নির্মাণের প্রতি যাঁর এত খিদে, সেই ভারতীয় পরিচালক নিজের প্রিয় চলচ্চিত্রজগৎ থেকেই অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন নিতে হল তাঁকে?
১৯৭৭ সালের ৮ এপ্রিল কেরলের তিরুঅনন্তপুরমের একটি গ্রামে জন্ম সনলকুমার শশিধরনের। মালয়ালম চলচ্চিত্রজগতের খ্যাতনামী পরিচালক তিনি। কেরিয়ারের ঝুলিতে একাধিক সফল ছবি রয়েছে তাঁর। অথচ আর ছবি তৈরি করবেন না বলে জানিয়েছেন তিনি।
কেরলের একটি কলেজ থেকে প্রাণিবিদ্যা নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন সনল। তার পর আইনবিদ হিসাবেই কেরিয়ার গড়ে তোলেন তিনি। কলেজে থাকাকালীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও যুক্ত হন। কিছু দিন পর মতাদর্শের পার্থক্য হওয়ায় দল ছেড়ে দেন সনল। পরে বিজেপি সরকারকে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি তিনি।
২০০০ সালে মালয়লম ফিল্মজগতে পা রাখেন সনল। ‘মালকোলঙ্গল’ নামের একটি ছবিতে আর্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করেন তিনি। এক বছর পর ২০০১ সালে সনল তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে একটি ফিল্ম সোসাইটি চালু করেন। নবাগত পরিচালকেরা যাঁরা অন্য ধরনের ছবি বানাতে চান, এই সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হলে অনলাইন মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে ছবির প্রযোজনাও করতে পারেন।
২০০১ সালে ‘অতিশয়লোকম’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করেন সনল। তার পর সাত বছরের বিরতি। ২০০৮ সালে ‘প্যারোল’ নামে আরও একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি পরিচালনা করেন তিনি। তাঁর কয়েক জন বন্ধু মিলে এই ছবি প্রযোজনা করেন।
কেরিয়ারে তৃতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘ফ্রগ’। এই ছবি পরিচালনার জন্য পুরস্কার পান সনল। স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ছেড়ে এ বার পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি পরিচালনার কাজেও মন দেন তিনি। ২০১৪ সালে মুক্তি পায় ‘ওরালপোক্কাম’ ছবিটি। এটি প্রথম মালয়ালম ছবি, যার জন্য অনলাইন মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। সেরা পরিচালকের পুরস্কারও পান তিনি।
‘ওজিভু দিবাসাথে কালী’ নামের একটি ছবি পরিচালনা করে সেরা পরিচালকের সম্মান পান সনল। কেরল এবং গোয়ার চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর এই ছবিটি প্রদর্শিত হয়।
‘সেক্সি দুর্গা’ নামে একটি ছবি তৈরি করেন সনল। কিন্তু ছবির নাম ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়। পরে নাম পরিবর্তন করে ‘এস দুর্গা’ রাখা হয়। ভারতীয় সেন্সর বোর্ডের তরফে দেশে মুক্তির অনুমতি দেওয়া না হলেও বিদেশের বেশ কিছু চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবি দেখানো হয়। পরিচালক হিসাবে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসা পান সনল।
২০১৮ সাল থেকে আরও চারটি ছবির পরিচালনা করতে দেখা যায় সনলকে। প্রতিটি ছবিই বিদেশের নানা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। ২০২১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ভাজ়াক্কু’ ছবিটি শেষ পরিচালনা করেন তিনি।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সনল জানান, তাঁর সৃষ্টির কারণে নানা ধরনের হুমকি পাচ্ছেন তিনি। এমনকি কয়েক বছর আগে তাঁর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনা হয়। সনলের দাবি, এই অভিযোগ অসত্য।
সনলের মন্তব্য, ‘‘মালয়লম ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে টাকার খেলা চলে। অনেক ছবি ১০০ কোটি টাকা খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু ভাল করে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেই ছবি তৈরি করতে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বড় মাপের রাজনীতিবিদেরা এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।’’
মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রির অন্ধকার দিক নিয়ে অনেকে অবগত হলেও তা নিয়ে কখনও প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। কিন্তু সনল ভয় না পেয়ে এর বিরুদ্ধে সরব হন। সনলের দাবি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারণে তার ফলও পেতে হয়েছে তাঁকে।
২০২২ সালের মে মাসের এক সকালে সনলকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তখনই তিনি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভারত ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান তিনি।
সাক্ষাৎকারে সনল বলেন, ‘‘দু’বছর কেটে গিয়েছে। অথচ আমার বিরুদ্ধে কোনও মামলা দায়ের করা হয়নি। যদি আমি এখন কেরলে থাকতাম, ছবি বানাতাম তবে আমার প্রাণটাই থাকত না। সারা ক্ষণ আমায় হুমকি দেওয়া হত।’’
সনল বিয়ে করলেও বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে তাঁর। সনলের কন্যা তাঁর প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গেই থাকেন। সাক্ষাৎকারে সনল বলেন, ‘‘আমি এখন আর ছবি বানাই না। ভারতে ফিরে যাওয়ার মতো আর কিছু নেই। এই একাকিত্বই আমার সঙ্গী। নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালই লাগে আমার।’’ ইনস্টাগ্রামে অ্যাকাউন্ট রয়েছে সনলের। তবে সেখানে তাঁর অনুগামীর সংখ্যা দশ হাজারের গণ্ডিও পার করতে পারেনি।