রাত বাড়ছে। এখনও কেউ বাড়ি ফিরছে না কেন! গত ৭ মে রাতে বার বার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বাড়ির মধ্যে দ্রুত পদে পায়চারি করছিলেন কুন্নুম্মল সাইথলভি।
পরিবারের সকলে থুভাল থিরাম পর্যটনকেন্দ্রে ঘুরতে গিয়েছেন ওই দিন। টিভিতে কিছু ক্ষণ আগেই দেখিয়েছে, সেখানে হাউসবোট দুর্ঘটনায় জলে ডুবে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। তার পর থেকেই দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে সাইথলভি এবং তাঁর ভাই সিরাজের।
টিভিতে দুর্ঘটনার খবর দেখার পর থেকেই সাইথলভির মনে শঙ্কার কালো মেঘ জমেছিল। তবুও মনে জোর নিয়ে বসেছিলেন তিনি। তাঁর মনে হচ্ছিল, ভগবান এত বড় অবিচার তাঁর সঙ্গে করবেন না।
বসে বসে পরিবারের সকলের ফেরার অপেক্ষা করছেন, এমন সময় একটা পরিচিত শব্দ ভেসে এল সাইথলভির কানে। শব্দটা খুব চেনা চেনা। অ্যাম্বুল্যান্সের কি? একদৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে আসেন তিনি। দূর থেকে দেখতে পান লাল-নীল বাতি লাগানো একটি গাড়ি তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে। অশনি সঙ্কেতের কথা ভেবে মাথা ভোঁ ভোঁ করতে শুরু করে তাঁর। চোখ ঝাপসা হতে শুরু করে।
কেরলের মালাপ্পুরমের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র থুভাল থিরাম। রবিবার সন্ধ্যায় সেখানেই একটি জলাশয়ে হাউসবোটে থাকার আনন্দ উপভোগ করছিলেন পর্যটকেরা। নৌকাটি হঠাৎ উল্টে যায়। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ দুর্ঘটনাটি ঘটে। সেই ঘটনায় মোট ২২ জনের মৃত্যু হয়। যার মধ্যে বেশির ভাগই শিশু।
মালাপ্পুরমের হাউসবোট দুর্ঘটনায় মৃত ২২ জনের মধ্যে ১১ জনই সাইথলভির পরিবারের সদস্য। তাঁর স্ত্রী এবং চার সন্তান, সকলেই এই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে।
সাইথলভির পরিবারের ১৫ সদস্য থুভাল থিরাম ঘুরতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়া বোটহাউসটিতে চেপেছিলেন। বোট উল্টে তাঁদের মধ্যে ১১ জনের মৃত্যু হয়। রাতেই সাইথলভির কাছে পৌঁছে যায় শোকবার্তা।
শোকে পাথর সাইথলভি জানান, থুভাল থিরাম ঘুরতে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের কাছে মোট তিনটি মোবাইল ছিল। কিন্তু টিভিতে দুর্ঘটনার খবর দেখে বার বার ফোন করেও কোনও লাভ হয়নি। কেউ ফোন তোলেননি।
সাইথলভি এবং তাঁর ছোট ভাই সিরাজ পরিবারের সঙ্গে থুভাল থিরাম থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে পুথানকাদাপুরমের পৈতৃক বাড়িতে থাকতেন। তাঁদের মা-ও দু’ভাইয়ের সঙ্গেই থাকতেন।
দুর্ঘটনা ঘটার দু’দিন আগেই সাইথলভির বিবাহিত বোন বাপের বাড়ি এসেছিলেন। তার পরই থুভাল থিরামে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ঘুরতে যাওয়ার কথা জানানো হয় সাইথলভির দত্তক ভাই জাবির এবং তাঁর পরিবারকেও। সঙ্গ দিয়েছিলেন প্রতিবেশী আসিফা এবং তার দুই সন্তানও। রবিবার সন্ধ্যায় সাইথলভির পরিবার এবং আসিফার পরিবারের মোট ১৯ জন ওই পর্যটনকেন্দ্রে ঘুরতে গিয়েছিলেন।
সাইথলভি জানান, তাঁরও পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কাজ পড়ে যাওয়ায় তিনি না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
সাইথালভি বলেন, ‘‘আমি ওদের সকলকে বার বার নৌকায় চাপতে বারণ করেছিলাম। কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম, ওই সময় নৌকাভ্রমণ নিরাপদ হবে না।’’
সাইথলভির প্রতিবেশী আসিফা দুর্ঘটনার কবলে পড়েননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা সকলে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঠিক তখনই টিকিটের মূল্যে বিশাল ছাড়ের কথা ঘোষণা করে হাঁকাহাঁকি শুরু করেছিলেন হাউসবোটের চালকেরা। শিশুদের জন্য বিনামূল্যে টিকিট দেওয়ার কথাও ঘোষণা হয়। আকর্ষণীয় প্রস্তাব পেয়ে সকলেই নিজেদের মত বদলে ফেলেন। ঠিক করা হয় সকলে মিলে হাউসবোটে চাপা হবে।’’
আসিফা আরও জানান, সকলে বোটে চাপলেও তিনি সেই সাহস করেননি। সন্তানদের নিয়ে পারেই থেকে যান। সাইথলভির পরিবারের সদস্যরা একটি দোতলা বোটে চেপে বসেন।
কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই ঘটে যায় বিপর্যয়। আসিফার চোখের সামনেই জলাশয়ের মাঝামাঝি গিয়ে ডুবে যায় বোটটি। মারা যান ২২ জন। চোখের সামনে এত জনকে ডুবে যেতে দেখেন আসিফা।
সাইথলভির চার কন্যা এবং ভাই সিরাজের আট মাসের শিশু-সহ তিন সন্তান ছিল। দুই ভাইয়ের সাত সন্তানই বোটহাউস দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে। মারা গিয়েছেন তাঁদের স্ত্রীরাও। দত্তক ভাই জাবিরের স্ত্রী ও এক ছেলেরও দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে।
পরিবারের পাঁচ জন দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরেছেন। সাইথলভির বোন নুসরত, নুসরতের দেড় বছরের কন্যা আয়েশা, জাবির এবং জাবিরের দুই সন্তান, জারশা এবং জান্না। তাঁরা সকলেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।