২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাজধানী দিল্লির বুকে ঘটে যাওয়া নির্ভয়াকাণ্ড তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল দেশ জুড়ে। ঠিক তেমনই উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে কামদুনি গ্রাম। বছর নয়েক আগে ওই গ্রামে ঘটে যাওয়া একটি ধর্ষণের ঘটনা ঝড় তুলেছিল রাজ্যে।
২০১৩ সালের ৭ জুন। দিনটা ছিল বুধবার। বৃষ্টি হচ্ছিল। ওই দিন বিকেলে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন ডিরোজিও কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী। কামদুনি বাস স্ট্যান্ডে তাঁর ভাইয়ের যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি আসতে দেরি করায় ওই তরুণী একাই রওনা দেন বাড়ির উদ্দেশে। কিন্তু নিজের এলাকাতেও নিরাপদ ছিলেন না তিনি।
হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে ওই তরুণীকে টেনেহিঁচড়ে পাঁচিলঘেরা পরিত্যক্ত একটি জায়গায় নিয়ে যান ৯ দুষ্কৃতী। সেখানে দুষ্কৃতীরা ওই তরুণীকে ধর্ষণ করেন।
এর পর গভীর রাতে ওই জায়গায় পাওয়া যায় তরুণীর ব্যাগ। পাওয়া যায় ওই তরুণীর ছিন্নভিন্ন দেহও।
ওই ঘটনার নৃশংসতা ছিল শিউরে ওঠার মতো। নিহত তরুণীর পরিবারের দাবি, তাঁর উপর শারীরিক নির্যাতন চালানোর পর দুষ্কৃতীরা তাঁর দেহ চিরে দেয় নাভি পর্যন্ত।
ওই বছরেরই ৯ জুন প্রাথমিক ভাবে কামদুনিকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত আনসার আলি মোল্লা-সহ তিন জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ওই ঘটনায় ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীদের একাংশ দোষীদের চরম শাস্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। সেই আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন নিহত তরুণীর সহপাঠী টুম্পা কয়াল এবং মৌসুমি কয়াল। ওই আন্দোলনে শামিল হন রাজ্যের বিদ্বজ্জনেদের একাংশও। কামদুনিকাণ্ড নিয়ে তপ্ত হয়ে ওঠে বিধানসভাও।
এর পর কামদুনিতে গিয়ে গ্রামবাসীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এবং বসিরহাটের সাংসদ হাজি নুরুল ইসলাম।
ওই বছরের ১০ জুন কামদুনিকাণ্ডের তদন্তভার দেওয়া হয় সিআইডিকে। ওই কাণ্ডে গ্রেফতার করা হয় মোট ৯জনকে।
ওই বছরেরই ১৭ জুন কামদুনিতে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন ১৫ দিনের মধ্যে ধৃতদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেবে পুলিশ। সরকার দোষীদের মৃত্যুদণ্ডের জন্য আবেদন করবে বলেও জানান তিনি। নির্যাতিতা তরুণীর পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের পর কামদুনির প্রতিবাদ মঞ্চ থেকে সরে যায় নির্যাতিতা তরুণীর পরিবার। তবে আন্দোলন তখনও চালিয়ে যায় ওই মঞ্চ।
কামদুনিকাণ্ডের ২২ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২০১৩ সালের ২৯ জুন জেলা আদালতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করা হয়। এর পর দিন দশেকের মাথায় দেওয়া হয় অতিরিক্ত চার্জশিটও।
কামদুনিকাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভ আছড়ে পড়ে জেলা আদালতের বাইরেও। এর ফলে ওই বছরেরই ১২ অগস্ট কামদুনি মামলা বারাসত থেকে নগর ও দায়রা আদালতে স্থানান্তরিত করার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্ট।
কামদুনির ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছিল সইফুল আলি মোল্লা, আনসার আলি মোল্লা, আমিন আলি, ইমানুল হক, গোপাল নস্কর, ভোলা নস্কর, আমিনুল ইসলাম, রফিক গাজি এবং নুর আলিকে। এর মধ্যে হেফাজতে থাকাকালীন মৃত্যু হয় গোপাল নস্করের। যে পাঁচিলঘেরা জায়গায় গণধর্ষণ করা হয়েছিল, সেখানকার কেয়ারটেকার ছিলেন গোপাল।
২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর শেষ হয়েছিল কামদুনিকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া। ভয়াবহ ওই ঘটনায় আড়াই বছর পর ২৮ জানুয়ারি রায় ঘোষণা হয় কামদুনি মামলায়।
কামদুনি মামলার রায় ঘোষণা করেন নগর দায়রা আদালতের দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক সঞ্চিতা সরকার। ওই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়, সইফুল আলি মোল্লা, আনসার আলি মোল্লা, আমিন আলি, ইমানুল হক, ভোলা নস্কর এবং আমিনুল ইসলামকে। বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয় রফিক গাজি এবং নুর আলিকে।
দোষীদের মধ্যে আনসার আলি মোল্লা, সইফুল আলি এবং আমিন আলিকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়। আমৃত্যু যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় শেখ ইনামুল ইসলাম, ভোলানাথ নস্কর এবং আমিনুর ইসলামকে।
৯ বছর পর আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে সেই নৃশংস ঘটনা। কারণ সম্প্রতি হাই কোর্টে কামদুনিকাণ্ডে সাজাপ্রাপ্তদের আইনজীবীরা আবেদন করেছেন, দোষীদের মধ্যে ৫ জনের সাজা মকুব করা হোক অথবা সাজা কমানো হোক। তাঁদের বক্তব্য, ওই ঘটনায় মূল ভূমিকা ছিল আনসার আলি মোল্লা নয়, সইফুল আলি মোল্লার। এই যুক্তিকে সামনে রেখেই হাই কোর্টে ৫ জনের সাজা মকুব করার আবেদন জানিয়েছেন আইনজীবীরা। পাশাপাশি, সইফুলের প্রাণভিক্ষার আবেদনও করা হয়েছে।