কথায় আছে, কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। এক সময় দিনরাত এক করে পরিশ্রম করেছিলেন। সেই শ্রম যে বিফল হয়নি, তা কয়েক বছর বাদেই হাতেনাতে টের পেয়েছিলেন ব্যবসায়ী জয়রাম বনান। এক সময় যে হাতে হোটেলে থালাবাসন সাফ করতেন, পরে সেই হাত দিয়েই গুনেছেন গোছা গোছা টাকা। গরিব ঘরের ছেলে থেকে জয়রামের কোটিপতি হওয়ার কাহিনি যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।
কর্নাটকের মেঙ্গালুরুর উদুপিতে জন্ম জয়রামের। তার বাবা ছিলেন গাড়িচালক। গরিবের সংসারে বেড়ে ওঠা তাঁর।
পড়াশোনায় তেমন ভাল ছিলেন না জয়রাম। স্কুলের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেই কড়া শাসন করতেন বাবা। এই বকুনিই যেন তাঁকে আগামী দিনের পথ দেখাল।
এক বার স্কুলের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন জয়রাম। বাবার বকুনির ভয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৩ বছর।
১৮৬৭ সাল। বাবার পকেট থেকে কিছু টাকা নিয়ে মেঙ্গালুরু থেকে বাসে চড়ে সোজা মুম্বই পাড়ি দেন জয়রাম। সেই থেকে শুরু হল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লড়াই।
সেই সময় অনেকেই কাজের জন্য মুম্বই পাড়ি দিয়েছিলেন। লোকে বলে, মুম্বই কখনই কাউকে খালি হাতে ফেরায় না। জয়রামের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
মুম্বইয়ে পা রেখেই লড়াকু জীবন শুরু হল জয়রামের। নিজের পায়ে দাঁড়াতে সেই সময় একটি হোটেলে কাজ শুরু করেন তিনি। ওই হোটেলে থালাবাসন পরিষ্কার করতেন জয়রাম। এ জন্য পারিশ্রমিক হিসাবে পেতেন ১৮ টাকা।
ওই হোটেলে প্রায় ৬ বছর কাজ করেছিলেন জররাম। এই সময়ের মধ্যে ‘পদোন্নতি’ ঘটেছিল জয়রামের। বাসন পরিষ্কারের কাজের পাশাপাশি হোটেলে ‘ওয়েটার’ (খাবার পরিবেশক) হন। পরে হোটেলের ম্যানেজারও হন তিনি।
হোটেলে কাজ করার সময়ই জয়রাম জানতে পারেন যে, মুম্বইয়ে দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের রেস্তরাঁ খোলা হচ্ছে। নিজে দক্ষিণ ভারতীয় হওয়ায় তিনিও এই ধরনের রেস্তরাঁ খোলার পরিকল্পনা করেন। তবে মুম্বইয়ের বদলে চলে যান দিল্লিতে।
তবে দিল্লিতে তাঁর পরিকল্পনা প্রথমে সফল হয়নি। নিরামিষ আহারের রেস্তরাঁ খুলতে চেয়েছিলেন জয়রাম। ওই সময় দিল্লিতে একটি উদুপি রেস্তরাঁয় কাজ করতেন তাঁর এক ভাই। ১৯৭৪ সালে দিল্লিতে আসার পর সেন্ট্রাল ইলেক্ট্রনিক্সের ক্যান্টিনের টেন্ডার নেন জয়রাম।
এর পর ১৯৮৬ সালে দিল্লির ডিফেন্স কলোনিতে নিজের রেস্তরাঁ খোলেন জয়রাম। নাম দেন ‘সাগর’। যা কিছু সঞ্চয় ছিল, তা দিয়ে প্রথম রেস্তরাঁ খোলেন তিনি। সেই সময় তাঁকে সাহায্য করেছিলেন বন্ধু-পরিজন।
সেই সময় রেস্তরাঁর ভাড়া মেটাতে হত জয়রামকে। প্রতি সপ্তাহে দিতে হত ৩ হাজার ২৫০ টাকা। রেস্তরাঁয় ৪০ জন এক সঙ্গে বসতে পারতেন। প্রথম দিন বিক্রি করে পেয়েছিলেন ৪৮০ টাকা।
ওই সময় দিল্লিতে দক্ষিণ ভারতীয় খাবার খেতে লোকে ‘উডল্যান্ড’, ‘দাসপ্রকাশ’ রেস্তরাঁয় যেতেন। ক্রেতাদের কাছে টানতে নতুন চাল চালেন জয়রাম। ‘উডল্যান্ড’ রেস্তরাঁটি কিনে ফেলেন তিনি। পরে ওই রেস্তরাঁর নাম বদলে রাখেন ‘সাগর রত্ন’।
সেই থেকে শুরু হয় ‘সাগর রত্ন’ রেস্তরাঁর পথচলা, যা পরবর্তী সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। উত্তর ভারতের ‘দোসা কিং’ বলা হতে থাকে জয়রামকে।
উত্তর ভারতে জয়রামের রেস্তরাঁর ৫০টিরও বেশি শাখা রয়েছে। বিশ্ব জুড়ে এই রেস্তরাঁর শাখা রয়েছে ১০০টিরও বেশি।
মাত্র ১৮ টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন রোজগার জীবন। সময়ের স্রোত পেরিয়ে সেই জয়রাম এখন কোটিপতি। এত রেস্তরাঁর সুবাদে তাঁর বছরে আয় ৩০০ কোটি টাকা।
‘জয়রাম বনান গ্রুপ’-এর চেয়ারম্যান তিনি। এই সংস্থার আওতায় রয়েছে রেস্তরাঁ, হোটেল, ক্যান্টিন।
জয়রামের জীবন রুপোলি পর্দায় নায়কের চরিত্রের মতোই। গরিব ঘরের ছেলে। পড়াশোনার পাঠ মাঝপথে ছেড়ে ঘর ছেড়ে বেরোন। তার পর কৃচ্ছ্রসাধনের পর নিজের পায়ে দাঁড়ান। সিনে দুনিয়ায় এমন নায়কের গল্প তো আকছার দেখা যায়। জয়রাম যেন বাস্তবের সেই নায়ক। তাঁর এই ‘নায়ক’ হয়ে ওঠার কাহিনি অনেককেই প্রেরণা জোগায়।