২৫ দিনের মধ্যেই ইরানি হামলার জবাব দিয়েছে ইজ়রায়েল। আর তাতেই যে ইহুদিদের প্রতিশোধস্পৃহা মিটেছে, এমনটা মানতে নারাজ দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের অনুমান, উল্টে এবার শিয়া মুলুকটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেইকে নিশানা করবেন তাঁরা। সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই তার ছক কষা শুরু করেছে ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)।
ইজ়রায়েল ও আমেরিকাপন্থী বিশেষজ্ঞদের দাবি, খামেনেইকে দুনিয়া থেকে সরাতে পারলে পারস্য উপসাগরের তীরের দেশটিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা বদল সহজ হবে। দীর্ঘ দিন ধরেই যার চেষ্টা চালিয়ে আসছে ওয়াশিংটন। দ্বিতীয়ত, এতে ইহুদিদের দ্রুত যুদ্ধ জয়ের রাস্তা খুলবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এর উল্টো যুক্তিও রয়েছে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কথায়, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাকে খতম করতে ‘হার্মিস ৯০০ কোচাভ’ কিলার ড্রোন ব্যবহার করতে পারে ইহুদি সেনা। যা ২০২০ সালে আর্মেনিয়া ও আজ়ারবাইজানের মধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। সংঘর্ষ চলাকালীন আর্মেনীয় ট্যাঙ্ককে নিখুঁত নিশানায় উড়িয়েছিল এই ইজ়রায়েলি ড্রোন।
২০১৪ সালের প্যালেস্টাইনের গাজ়ায় ‘অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ’ চালানোর সময়ে প্রথম বার হার্মিস-৯০০ ব্যবহার করে আইডিএফ। এর পরই ওই ড্রোন কেনার ব্যাপারে আগ্রহী হয় আজ়ারবাইজান ও ব্রাজিল-সহ একাধিক দেশ। বর্তমানে একে ইহুদি বায়ুসেনার অন্যতম স্তম্ভ বলে ধরা হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০ হাজার ফুট উচ্চতায় একটানা ৩০ ঘণ্টা উড়তে পারে এই হার্মিস-৯০০।
ইজ়রায়েলি সংস্থা ‘এলবিট সিস্টেম’-এর তৈরি এই মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলির ৫০০ কেজি ওজন নিয়ে ওড়ার ক্ষমতা হয়েছে। সম্প্রতি এর ক্ষমতা সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ‘ডিফেন্স প্রোকিয়োরমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল’। সেখানে বলা হয়েছে, আইডিএফ আদর করে এই ড্রোনগুলিকে ‘স্টার’ বলে ডাকে।
ডিফেন্স প্রোকিয়োরমেন্টের রিপোর্টে বলা হয়েছে, চলন্ত গাড়ির মধ্যে চার জন আরোহী থাকাকালীন শুধুমাত্র চালককে নিশানা করার ক্ষমতা রয়েছে হার্মিস-৯০০। এটি দিয়ে ওই গাড়িতে হামলা করলে, দেখা যাবে শুধুমাত্র চালকের মৃত্যু হয়েছে। বাকিদের গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগেনি। এতটাই শক্তিশালী এই ড্রোন।
চলতি বছরের ১ অক্টোবর প্রায় ২০০টি ‘হাইপারসোনিক’ ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইহুদি ভূমিতে আক্রমণ শানায় তেহরান। যার অধিকাংশই মাঝ আকাশে ধ্বংস করেছিল তেল আভিভ। এর পরই প্রত্যাঘাতের হুঁশিয়ারি দেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সেই মতো ২৬ অক্টোবর রাজধানী-সহ শিয়া মুলুকের একাধিক জায়গায় ‘এয়ার স্ট্রাইক’ চালায় আইডিএফ।
সূত্রের খবর, প্রত্যাঘাতের সময়ে যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি দু’ধরনের ড্রোন ব্যবহার করেছে ইহুদি ফৌজ। যার মধ্যে রয়েছে হানাদার ‘হেরন’-এর নতুন সংস্করণ ও হার্মিস-৯০০। বিশেষজ্ঞদের দাবি, দ্বিতীয়টি ‘হার্মিস-৪০০’-এর আধুনিকতম সংস্করণ। বিভিন্ন ক্যাটেগরির গাইডেড বোমা নিয়ে এর ওড়ার ক্ষমতা রয়েছে। মানববিহীন উড়ুক্কু যানটিতে রয়েছে এইচডি অপটিক্যাল সেন্সর, এরিয়া সার্ভেল্যান্স সিস্টেম এবং লক্ষ্য স্থির করার লেজ়ার টার্গেট।
ইজ়রায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৬ তারিখ মোট তিনটি পর্যায়ে ইরানের ‘ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস’-কে (আইআরজিসি) নিশানা করে ইহুদি বায়ুসেনা। প্রথমে শিয়া দেশটির ‘বায়ু সুরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ধ্বংসের লক্ষ্য ছিল আইডিএফের।
তেল আভিভের এই প্রত্যাঘাতের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন ডেজ় অফ রিপেনট্যান্স’। বাংলা অনুবাদ করলে যা দাঁড়াবে, ‘অনুতাপের অভিযানের দিন’। এতে শতাধিক যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে ইহুদি বায়ুসেনা। যার মধ্যে বড় সংখ্যায় ছিল আমেরিকার তৈরি মাটির লক্ষ্যবস্তুতে হামলার উপযোগী এফ-১৫আই র্যাম ‘গ্রাউন্ড অ্যাটাক জেট’।
এ ছাড়া আমেরিকার ‘লকহিড মার্টিন’ সংস্থার তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের ‘এফ-৩৫ লাইটনিং-২’ মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান উড়িয়েছিল আইডিএফ। শব্দের থেকে দ্রুত গতিতে ছোটার ক্ষমতা রয়েছে যার। ‘স্টেলথ’ ক্যাটাগরির হওয়ায় এগুলি রাডারে প্রায় ধরা পড়ে না বললেই চলে। এই দুই যুদ্ধবিমানের সঙ্গে ছিল হামলায় ‘এফ-১৬আই সুফা’ এয়ার ডিফেন্স জেট।
আমেরিকার সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথমে ইরানের রাজধানী তেহরান এবং তার অদূরের কারাজ় শহরকে নিশানা করে ইজ়রায়েলের বায়ুসেনা। যুদ্ধবিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমাবর্ষণ করায় রীতিমতো কেঁপে ওঠে ওই দুই এলাকা। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দ্বিতীয় দফার হামলা শুরু করে আইডিএফ। এ বার ইহুদি বায়ুসেনার নিশানায় ছিল সিরাজ শহর।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার আক্রমণের সময়ে ইরানের ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ডস কর্পস’-এর (আইআরজিসি) সামরিক ঘাঁটিগুলি ওড়াতে যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া হয় ক্ষেপণাস্ত্র। পাশাপাশি, ইলাম এবং কুর্জ়েস্তান প্রদেশে অন্তত ২০টি লক্ষ্যে আঘাত হানে ইহুদি সেনা। রাডার নজরদারিকে ফাঁকি দিতে আইডিএফ উচ্চ প্রযুক্তির জ্যামার ব্যবহার করেছে বলে জানা গিয়েছে।
শিয়া মুলুকে এই হামলার সময়ে তেল আভিভের কিরিয়া সামরিক ঘাঁটির একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের সঙ্গে ছিলেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। আইডিএফের হামলার ‘সরাসরি সম্প্রচার’ দেখেন তিনি। পরে আক্রমণের ছবিও প্রধানমন্ত্রী দফতরে পাঠান আইডিফের ফৌজি জেনারেলরা।
অন্য দিকে হামলার সময়ে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেইনি নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন বলে সূত্র মারফত খবর এসেছে। ইহুদিদের আক্রমণ যখন-তখন আছড়ে পড়তে পারে, এই আশঙ্কা থেকে তাঁকে কয়েক দিন আগে গোপন জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যায় শিয়া ফৌজ। শুধু তাই নয় আলি খামেনেইয়ের নিরাপত্তা কয়েক গুণ বাড়িয়েছে আইআরজিসি।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৩) ৭ অক্টোবর প্যালেস্টাইনের গাজ়া থেকে ইজ়রায়েলে ঢুকে ভয়ঙ্কর হামলা চালায় ইরান সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘হামাস’। সেই আক্রমণে প্রাণ হারান প্রায় ১ হাজার ২০০ জন। এর পরই হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন নেতানিয়াহু। সম্প্রতি এই সংগঠনের শীর্ষনেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে নিকেশ করেছে আইডিএফ।
ইজ়রায়েল আক্রমণের ঝাঁজ বৃদ্ধি পেতেই হামাসের সমর্থনে এগিয়ে আসে ইরানের মদতপুষ্ট আরও দুই জঙ্গি সংগঠন। যার একটি হল লেবানের ‘হিজ়বুল্লা’ এবং অপরটি ইয়েমেনের ‘হুথি’। কিন্তু ইহুদি ফৌজের পাল্টা প্রত্যাঘাতে প্রাণ হারান হিজ়বুল্লার শীর্ষনেতা সৈয়দ হাসান নাসরাল্লা। লেবাননের রাজধানী বেইরুটে এয়ার স্ট্রাইক চালিয়ে তাঁকে নিকেশ করে আইডিএফ।
একের পর এক শীর্ষনেতাদের হারিয়ে প্রবল ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে হামাস ও হিজ়বুল্লা। এর মধ্যেই লেবাননে গ্রাউন্ড অপারেশন শুরু করে তেল আভিভ। অন্য দিকে হুথিদের কোমর ভাঙতে কয়েক দিন আগেই ইয়েমেনে তাদের গুপ্ত ঘাঁটিকে ‘বি-২’ বোমারু বিমান দিয়ে হামলা চালায় আমেরিকান বায়ু সেনা।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, হামাস ও হিজ়বুল্লার কায়দাতেই এ বার খামেনেইকে সরাতে চাইছে ইজ়রায়েল। নাসরাল্লার মৃত্যুর পর শিয়া মুলুকটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাকে শেষ বার প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল। তাঁকে খতম করলে ইহুদিদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে ইরান। আর তাই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেতানিয়াহু নেবেন বলে জানা গিয়েছে।