ইরানি আক্রমণের কড়ায়-গণ্ডায় প্রতিশোধ নিয়েছে ইজ়রায়েল। বিমানহানা চালিয়ে শিয়া মুলুকটিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে ইহুদি বায়ুসেনা। সেই ক্ষয়ক্ষতির চুলচেরা হিসাব এখনও করে উঠতে পারেনি তেহরান। যদিও তেল আভিভের দাবি, প্রত্যাঘাতে গুঁড়িয়ে দেওয়া গিয়েছে ইরানের ‘বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম)।
উল্লেখ্য, ইরানের ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’-এর (আইআরজিসি) হাতে যে বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, তার নাম ‘এস-৩০০’। এই হাতিয়ারের নির্মাণকারী দেশ হল রাশিয়া। ফলে ইজ়রায়েলের দাবি ঘিরে স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে একটি প্রশ্ন— তবে কি দিন ফুরোল রুশ অস্ত্রের?
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমেরিকার প্রতিরক্ষা দফতরের এক শীর্ষকর্তা। ‘ওয়াল স্ট্রিল জার্নাল’-কে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘‘রাশিয়ার এস-৩০০ বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বোকা বানিয়েছে ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। এই হাতিয়ারের অক্ষমতা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।’’
আমেরিকার এই দাবি যে খুব একটা ফেলে দেওয়ার নয়, তা এক রকম স্বীকার করছেন প্রাক্তন ফৌজি জেনারেলদের একাংশও। তাঁদের কথায়, ‘‘ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের পর ইহুদিদের একটা বিমানকেও ধ্বংস করতে পারেনি আইআরজিসির হাত থাকা রুশ এস-৩০০। এক রকম বিনা বাধায় শিয়া মুলুকটির আকাশে দাপিয়ে বেড়িয়েছে আইডিএফের বায়ুসেনা।’’
‘টাইম্স অফ ইজ়রায়েল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের হাতে মোট চারটি এস-৩০০ বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল। যার একটিকে চলতি বছরের এপ্রিলেই উড়িয়ে দেয় ইহুদি বায়ুসেনা। বাকি তিনটি অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের প্রত্যাঘাতে ধ্বংস করা গিয়েছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে এখনও মুখ খোলেনি শিয়া ফৌজ।
পারস্য উপসাগরের তীরে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনার প্রত্যাঘাত নিয়ে বিস্তারিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আমেরিকার গবেষণা সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার’। সেখানেও দাবি করা হয়েছে, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে এস-৩০০ মোতায়েন রয়েছে এমন তিন থেকে চারটি জায়গায় হামলা চালায় আইডিএফ। যার মধ্যে রয়েছে রাজধানী তেহরানের আলি খামেনাই বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বর্ষীয়ান পশ্চিম এশিয়া উপদেষ্টা আমোস হোচস্টেইন বলেছেন, ‘‘আইডিএফের আক্রমণে ইরান পুরোপুরি নগ্ন হয়ে গিয়েছে। শিয়া মুলুকটিতে হাওয়াই হামলা চালানো একেবারের ঝুঁকিপূর্ণ নয়। কারণ, আইআরজিসির হাতে বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে।’’
এখন প্রশ্ন হল, কী এই এস-৩০০? সোভিয়েত যুগে এই হাতিয়ার তৈরি করেছিল ‘এনপিও আলমাজ’ নামের একটি সংস্থা। এতে রয়েছে দূরপাল্লার ভূমি থেকে আকাশের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার ক্ষেপণাস্ত্র। শত্রু যুদ্ধবিমান, ক্রুজ় বা ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন মাঝ আকাশে উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এই এস ৩০০-র।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, রুশ হাতিয়ারটিকে বোকা বানাতে আগে থেকে পরিকল্পনা করেছিল ইহুদি বায়ুসেনা। প্রথমেই উচ্চ প্রযুক্তির জ্যামারের সাহায্যে এর রাডারকে শক্তিহীন করে ফেলে আইডিএফ। তার পর নিঁখুত নিশানায় এস ৩০০-র উপর যুদ্ধবিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালান তাঁরা।
সূত্রের খবর, শতাধিক যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানের উপর হামলা চালায় তেল আভিভ। আইডিএফের পাইলটেরা বসেছিলেন আমেরিকার তৈরি ‘এফ-১৫আই র্যাম গ্রাউন্ড অ্যাটাক জেট’ এবং পঞ্চম প্রজন্মের ‘এফ-৩৫ লাইটনিং-২’ মাল্টিরোল যুদ্ধবিমানে। এ ছাড়াও তাঁদের সঙ্গে উড়ছিল ‘এফ-১৬আই সুফা’ এয়ার ডিফেন্স জেট এবং হানাদার ‘হেরন’ ড্রোন।
বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, এই ঘটনায় ইজ়রায়েলি হামলায় কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রথমত, লকহিড মার্টিনের তৈরি এফ ৩৫-এর মতো ‘স্টেলথ’ ক্যাটেগরির যুদ্ধবিমানকে চিহ্নিত করার ক্ষমতা নেই এস ৩০০-র। দ্বিতীয়ত, জ্যামারের সাহায্যে এক বার এর রাডারকে অকেজো করতে পারলেই, আর ঠিকমতো কাজ করবে না এই বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। তৃতীয়ত, হানাদার ড্রোনকে চিহ্নিত করে এটি কতটা নিষ্ক্রিয় করতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
একটা সময়ে সোভিয়েত রাশিয়া, ইউক্রেন, বুলগেরিয়া এবং গ্রিসের সেনাবাহিনীর অস্ত্রাগারে শোভা পেত এস-৩০০। কিন্তু, পরবর্তী কালে অধিকাংশ দেশই এর ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। সূত্রের খবর, ইজ়রায়লি হামলার পর আরও উন্নত বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার খোঁজ শুরু করে দিয়েছে তেহরান। এর উন্নত সংস্করণ ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’ পেতে ফের এক বার মস্কোর মুখাপেক্ষী হতে পারে আইআরজিসি।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে অভিযান শুরু করে রাশিয়া। তার পর থেকেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে মস্কোর তৈরি একাধিক হাতিয়ার। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকা ও পশ্চিমি দেশের তৈরি করা বহু অস্ত্র বেশি কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে। উদাহরণ হিসাবে আমেরিকার ‘জ্যাভলিন’ ক্ষেপণাস্ত্রের কথা বলা যেতে পারে। যা দিয়ে সহজেই একের পর এক রুশ ট্যাঙ্ক উড়িয়েছে ইউক্রেনীয় ফৌজ।
দ্বিতীয় উদাহরণ ‘আর-৩৬০ নেপচুন’ অ্যান্টিশিপ ক্ষেপণাস্ত্র। যার আঘাতে কৃষ্ণ সাগরে রুশ যুদ্ধজাহাজ ‘মস্কোভা’-কে ডোবাতে সক্ষম হয় ইউক্রেনের সৈনিকরা। তা ছাড়া মস্কোর বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ফাঁক গলে বেশ কয়েক বার ড্রোন হামলা চালিয়েছে ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’। ফলে হাতিয়ারের দুনিয়ায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ‘দাদাগিরি’র দিন শেষ বলে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
আমেরিকা ও পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলিতে এই সংক্রান্ত একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও এর উল্টো যুক্তিও রয়েছে। সমর বিশেষজ্ঞদের কথায়, নিঃসন্দেহে রাশিয়ার থেকে আমেরিকা ও নেটোভুক্ত দেশগুলি ভাল হাতিয়ার তৈরি করে। কিন্তু তাই বলে রুশ অস্ত্রের কার্যকারিতা একেবারে শেষ, তা বলা যাবে না।
তাঁদের যুক্তি, ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কো এমন কয়েকটি হাতিয়ার ব্যবহার করেছে, যা আমেরিকা বা নেটোভুক্ত দেশগুলির কাছে নেই। উদাহরণ হিসাবে ‘জ়িরকম’ হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রের কথা বলা যেতে পারে। শব্দের চেয়ে ছ’গুণ গতিসম্পন্ন এই অস্ত্রের জন্যেই পশ্চিমি দুনিয়া সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারছে না।
তথ্য বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালীন বেশ কিছু রাশিয়ান হাতিয়ারের চাহিদা আকাশছোঁয়া হয়েছে। যার মধ্যে জ়িরকম ছাড়াও রয়েছে ‘কেএইচ ২২’ ক্ষেপণাস্ত্র, ‘ইউপিএবি ১৫০০’ গ্লাইডিং বোমা এবং ‘এসজে ১০০’ বিমান। আফ্রিকার বহু দেশ এগুলি কেনার জন্য ইতিমধ্যেই মস্কোর দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া আমেরিকার ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানকে গুলি করে নামাতে সক্ষম হয়েছে পুতিন ফৌজ।
বর্তমানে রাশিয়ার সেনাবাহিনী এস-৪০০ এবং এস-৫০০ নামের দু’ধরনের বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে। যা টপকে মূল রুশ ভূখণ্ডে হামলা চালানো যে বেশ কঠিন, তা মানেন নেটোর ফৌজি জেনারেলরাও। উল্লেখ্য, ভারতীয় বায়ুসেনার কাছেও রয়েছে এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।