আমেরিকার হাতে রয়েছে এক ‘গোপন অস্ত্র’। সেই অস্ত্র না থাকলে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আগেই ভেঙে পড়ত। কয়েক বছর আগে এমনটাই দাবি করেছিলেন আমেরিকার পদার্থবিদ তথা বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক মিশিয়ো কাকু।
শুধু কাকু নন, এমনটা দাবি করেছেন আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের অনেকেই।
কিন্তু কী সেই ‘গোপন অস্ত্র’? আন্তর্জাতিক শিক্ষা নিয়ে চর্চা করেন যাঁরা, তাঁদের মতে, আমেরিকার সেই গোপন অস্ত্রটি হল— সে দেশের এইচ ১বি ভিসা নীতি।
কয়েক বছর আগে কাকু একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে দাবি করেছিলেন, আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা আদপে খুবই খারাপ। কিন্তু ওই ভিসা নীতির জোরে বিজ্ঞান এবং শিক্ষার উচ্চস্তরে রাজ করছে আমেরিকা।
আমেরিকার হাতে এইচ ১বি ভিসা নীতি না থাকলে, সিলিকন ভ্যালিও তৈরি হত না, গুগ্লের মতো সংস্থাও তৈরি হত না, এমনটাই দাবি করেছেন কাকু।
কাকু বলেছিলেন, ‘‘আমেরিকায় সবচেয়ে খারাপ শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। গুগ্লের কথা ভুলে যান, কোনও সিলিকন ভ্যালিই থাকত না আমেরিকার। আমেরিকার গোপন অস্ত্র, ভিসা নীতি। ভিসায় আসা বিদেশিদের কারণে আমেরিকার বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে।’’
কিন্তু কী এই এইচ ১বি ভিসা নীতি? এইচ-১বি ভিসা কাজে লাগিয়ে আমেরিকার প্রযুক্তি সংস্থাগুলি অন্য দেশ থেকে দক্ষ পেশাদারদের ‘আমদানি’ করে।
বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী, আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি পেশাদার যান ভারত এবং চিন থেকে।
সেই পেশাদাররা আমেরিকা যান এইচ ১বি ভিসা নিয়ে। ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, আমেরিকায় গবেষণারত পড়ুয়াদের প্রায় অর্ধেক বিদেশি। যেমনটা দাবি করেছিলেন কাকু।
কাকু-সহ বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, যদি শুধুমাত্র আমেরিকার স্নাতকদের উপর নির্ভর করে সে দেশের বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান এবং প্রযুক্তিকেন্দ্রগুলি চলত, তা হলে আমেরিকার অর্থনীতি ভেঙে পড়ত।
তবে আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাকুর সেই পর্যবেক্ষণ ২০১৬ সালের। তার পর সরকার পাল্টেছে। টুকটাক বদল এসেছে ভিসা নীতিতেও।
আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় ছিলেন, সে সময় ভিসা নীতিতে কড়াকড়ি শুরু হয়।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা ভিসা নীতি নিয়ে ট্রাম্প যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার বিরূপ প্রভাব পড়ে ভোটবাক্সে। ক্ষমতায় আসার আগে বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ট্রাম্পের ভিসা নীতিতে আমূল পরিবর্তন আনবেন। সেই প্রতিশ্রুতি রাখাও হয়। এইচ ১বি ভিসাধারীদের স্ত্রী বা স্বামীদের জন্য এইচ-৪ ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাইডেন প্রশাসন।
ট্রাম্প প্রশাসন সেই ভিসা নীতির পক্ষে ছিল না। ট্রাম্পের লক্ষ্য ছিল বাইরে থেকে নয়, সে দেশে কাজের জন্য শুধুমাত্র আমেরিকানদেরই নেওয়া হবে। কিন্তু বাইডেন আসার পর ট্রাম্পের এই নীতি ধোপে টেকেনি। নতুন করে ভিসা নীতিতে বদল এনে আমেরিকার মাটিতে বিদেশিদের কাজের সুযোগ করে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।
তবে ২০২২ সাল থেকে আমেরিকায় প্রচুর পরিমাণ কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। কাজ খোয়ানো কর্মীদের ৩০%-৪০% ভারতীয়। কাজ গিয়েছে ভারত থেকে এইচ-১বি ভিসা নিয়ে সে দেশে যাওয়া বহু পেশাদারেরও।
দীর্ঘ মেয়াদে এর বিরূপ প্রভাব আমেরিকার উপরে পড়তে পারে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। সে দেশের ৭০% স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠাতাই অভিবাসী। নথিভুক্ত ৫০টিরও বেশি সংস্থার সিইও ভারতীয় বংশোদ্ভূত।
আশঙ্কা, দেশ থেকে প্রতিভা চলে যাওয়া আগামী দিনে আমেরিকার পক্ষে খারাপ হতে পারে।
পাশাপাশি কাকুর মতো একাধিক বিশেষজ্ঞের মতে, ভারত এবং চিনের মতো দেশ থেকে আমেরিকায় গিয়ে কাজ করার যে হিড়িক ছিল তা কমেছে। প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন, এমন অনেকে এখন দেশেই গবেষণা চালাতে চাইছেন।
পাশাপাশি, আমেরিকা থেকেও অনেকেই আবার দেশে ফিরছেন বলে দাবি করেছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞেরা। ফলে ক্রমশ ভোঁতা হচ্ছে আমেরিকার ‘গোপন অস্ত্র’।
ফলে আমেরিকার বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ ধীরে ধীরে অন্ধকারে যেতে পারে বলেও মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহলের অনেকে।
কাকুর মতো বিশেষজ্ঞ, যাঁরা মনে করেন, বিদেশি পড়ুয়া বা প্রযুক্তিবিদ ছা়ড়া আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা তলানিতে যেতে পারে, তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণীও কি মিলতে চলেছে? উঠছে প্রশ্ন।