যত সময় গড়াচ্ছে, ততই কমছে ডলারের নিরিখে টাকার দর। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দর। এই পরিস্থিতি অর্থনীতিবিদদের চিন্তা বাড়িয়েছে। এর ফলে আগামী দিনে কোটি টাকারও যে মূল্য হ্রাস পেতে চলেছে, তা বলাই বাহুল্য।
ভারতীয় মুদ্রায় অবমূল্যায়নের নেপথ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে মুদ্রাস্ফীতিকে চিহ্নিত করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, এটি আমজনতার দৈনন্দিন জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। কারণ, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি মধ্য এবং নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের উপার্জনের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে।
মুদ্রাস্ফীতির দ্বিতীয় সমস্যা হল দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় মূল্য হ্রাস। এর জেরে ভবিষ্যতের জন্য জমানো টাকার আসল মূল্য কমে যায়। প্রবীণ নাগরিকদের জন্য এই বিষয়টি সবচেয়ে চিন্তার।
চলতি বছরের অক্টোবরে দেশে খুচরো মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৬.২১ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধির সূচক ছ’শতাংশে দাঁড়িয়ে থাকলে তিন এবং পাঁচ বছর পর কোটি টাকার অনেকটাই অবমূল্যায়ন হবে। মুদ্রাস্ফীতির হার আরও বাড়লে ব্যস্তানুপাতিক হারে কমবে টাকার দর।
মুদ্রাস্ফীতির হার ওঠানামা করলে টাকার মূল্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা জানার নির্দিষ্ট একটি সূত্র রয়েছে। সেটি হল, মুদ্রাস্ফীতির পর মূল্য = বর্তমান টাকার অঙ্ক × (১ − মূল্যস্ফীতির হার)।
উদাহরণ হিসাবে আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৫) কথা বলা যেতে পারে। ধরে নেওয়া যাক, ওই সময়ে মুদ্রাস্ফীতির হার ছ’শতাংশই থাকছে। সে ক্ষেত্রে এক কোটি টাকার মূল্য কমে ৯৪ লাখে গিয়ে দাঁড়াবে।
সূত্র অনুযায়ী টাকার মূল্যের অঙ্কটি দাঁড়াবে, মুদ্রাস্ফীতির পরের মূল্য = বর্তমান টাকার অঙ্ক X (১–মুদ্রাস্ফীতির হার) অর্থাৎ ১,০০,০০,০০০ X (১ – ০.০৬) = ৯৪,০০,০০০ টাকা।
একই ভাবে তিন বছর পরে আরও কমবে টাকার মূল্য। মুদ্রাস্ফীতির হার ছ’শতাংশে আটকে থাকলে ওই সময়ে এক কোটি টাকার দাম দাঁড়াবে ৮৩ লক্ষ ৫২ হাজার ১৬০ টাকা।
আবার এই সূত্রে পাঁচ বছর বছর এক কোটি টাকার মূল্য কমে ৭৪ লক্ষ ৭২ হাজার ৫৮০ টাকায় চলে আসবে। এ ক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতির হার ছ’শতাংশ বজায় থাকবে ধরে নিয়ে এই হিসাব করা হয়েছে।
এ বছরের সেপ্টেম্বরে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৫.৪৯ শতাংশ। অক্টোবরে গত ১৪ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছয় মুদ্রাস্ফীতির হার। একে শুধু নিয়ন্ত্রণে রাখা নয়, বরং মুদ্রাস্ফীতির সূচক নিম্নমুখী করতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই)।
কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক অবশ্য জানিয়েছে, বর্তমানে সহ্যসীমার মধ্যেই রয়েছে মুদ্রাস্ফীতির হার। তবে এর জন্য খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্র আবার এর জন্য পেঁয়াজ, আলু, টম্যাটোর মতো বেশ কয়েকটি সব্জির মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করেছে।
সাধারণত, প্রতি তিন মাস অন্তর বৈঠকে বসে আরবিআইয়ের মুদ্রানীতি কমিটি। সেখানে মুদ্রাস্ফীতির হার নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর সূচক বৃদ্ধি পেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।
মুদ্রাস্ফীতির হারের উপর নির্ভর করে রেপো রেটও। বর্তমানে যা ৬.৫ শতাংশ রেখেছে আরবিআই। এ বছরের ডিসেম্বরে ফের বৈঠকে বসবেন মুদ্রা নীতি কমিটির সদস্যেরা। সেখানে রেপো রেটের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৩) অগস্টের পর মুদ্রাস্ফীতির হার কখনই আরবিআইয়ের উচ্চ সহনশীলতাকে অতিক্রম করেনি। এ বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথম বার চার শতাংশকে ছাপিয়ে যায় এর সূচক। এটি গত ন’মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল বলে জানা গিয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি পেতে সাধারণত জিডিপির সূচক নেমে যায়। ফলে নিম্নমুখী হয় আর্থিক বৃদ্ধির সূচক।
আরবিআইয়ের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস বলেছেন, ‘‘মুদ্রাস্ফীতির সূচক চার শতাংশের নীচে রাখাই আমাদের লক্ষ্য। একে তিন শতাংশে নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।’’ তবে এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সঠিক দিশায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
চলতি আর্থিক বছরে (২০২৪-২৫) দেশের জিডিপির হার সাত শতাংশের নীচে থাকবে বলে জানিয়েছে আরবিআই। আগামী আর্থিক বছরে এটি ৬.৩ শতাংশে যেতে পারে বলে মনে করছে বহু আর্থিক সমীক্ষক সংস্থা। এ ব্যাপারে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি আরবিআই।