ভারতে তেল রফতানিকারক দেশগুলির শীর্ষে রাশিয়া। ভারতকে তার চাহিদার ৮৫ শতাংশ তেলই আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে। এর মধ্যে আমদানি খরচ কমানোর জন্য রাশিয়া থেকে অশোধিত তেল কেনার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারত।
ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পরে পশ্চিমি দুনিয়ার নিষেধাজ্ঞা এড়াতে কম দামে তেল বিক্রি করে শুরু করেছিল রাশিয়া। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি ভারত। মস্কো থেকে তেল আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় নয়াদিল্লি। তার বদলে পশ্চিম এশিয়া এবং তেল রফতানিকারক দেশগুলির সংগঠন ওপেকের থেকে তেল কেনা কমিয়ে দেয় ভারত।
কিন্তু আড়াই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিপদ বাড়ছে এ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলির। কারণ, রুশ তেল সংস্থায় আটকে রয়েছে ভারতীয় তেল সংস্থাগুলির মুনাফার একটা বড় অংশ। তেল সংস্থাগুলি প্রায় ৭ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা ফেরত পাচ্ছে না বলে সূত্রের খবর। ঘটনায় চাপে পড়েছে ভারতীয় তেল সংস্থাগুলি।
ওএনজিসির আন্তর্জাতিক শাখা ওএনজিসি বিদেশ, অয়েল ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন এবং ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের শাখা ভারত পেট্রোরিসোর্স— এই চারটি সংস্থার অংশীদারি রয়েছে রাশিয়ার চারটি জ্বালানি প্রকল্পে।
ওএনজিসির আন্তর্জাতিক শাখা ওএনজিসি বিদেশের হাতে রয়েছে পশ্চিম সাইবেরিয়ার ভ্যাঙ্করনেফ্ট তেল প্রকল্পের ২৬% অংশীদারি। আরও ২৩.৯% রয়েছে ইন্ডিয়ান অয়েল, অয়েল ইন্ডিয়া এবং ভারত পেট্রোরিসোর্সেসকে নিয়ে গঠিত গোষ্ঠীর হাতে।
২০২২ সালে শুরু হওয়া যুদ্ধের ফলে আর্থিক অবরোধের মুখে পড়ে মস্কো। পশ্চিম দুনিয়ার বিভিন্ন অবরোধের জালে জড়িয়ে থাকার ফলে সেই লভ্যাংশ জমা হচ্ছে রুবলে। সেই লাভের টাকাই পড়ে রয়েছে রাশিয়ার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।
রাশিয়ার যে ব্যাঙ্কে টাকা জমা হচ্ছে সেটি হল কমার্শিয়াল ইন্দো ব্যাঙ্ক, যা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অনুমোদিত।
ভারতীয় তেল সংস্থাগুলি তাদের রাশিয়ান অংশীদারদের সঙ্গে একাধিক বার এই সমস্যাটি নিয়ে আলোচনায় বসলেও স্থায়ী সমাধান বেরোয়নি। নয়াদিল্লি এবং মস্কোর মধ্যে সরকারি স্তরে আলোচনা সত্ত্বেও জট কাটেনি।
ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের পরে রাশিয়ার প্রথম সারির ব্যাঙ্কগুলি আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন প্রযুক্তি ব্যবস্থা (সুইফ্ট) থেকে বাদ পড়ে। তাই লভ্যাংশ ফিরিয়ে আনতে পারছে না ভারতীয় সংস্থাগুলি।
পাশাপাশি, যুদ্ধ শুরুর পর পরই পশ্চিমি নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া যে ধাক্কা খেয়েছিল, সময়ের সঙ্গে তা সামলে উঠেছে মস্কো। তাদের তেলের বাণিজ্যে খুব একটা প্রভাব পড়েনি।
ভারতীয় তেল সংস্থার আধিকারিকেরা মনে করছেন, রাশিয়ায় তেল প্রকল্পে আটকে থাকা অর্থ ভারতে ফিরিয়ে না আনার বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কী সেই পন্থা? রাশিয়ার ব্যাঙ্কে জমা টাকা ফেরত না পাওয়া গেলে তার বিকল্প পন্থা সেই প্রকল্পগুলিতেই পুনর্বিনিয়োগ করা।
তবে চলতে থাকা প্রকল্পগুলিতে আপাতত আরও মূলধন বিনিয়োগের কোনও পরিকল্পনা নেই ভারতীয় তেল সংস্থাগুলির। এমনটাই জানিয়েছেন সংস্থার এক আধিকারিক। বর্তমানে রাশিয়ায় কোনও নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের সন্ধান করছেন না তাঁরা।
তবে এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ওএনজিসি বিদেশ। এই ভারতীয় সংস্থা রাশিয়ার জ্বালানি প্রকল্প শাখালিনের অংশীদার। শাখালিনের শেয়ার পুনরায় মনোনীত করার জন্য রাশিয়াকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা দিতে হবে ওএনজিসি বিদেশকে। সংস্থাটি তার আটকে থাকা লভ্যাংশ আংশিক ভাবে এই প্রকল্পের শেয়ারে বিনিয়োগ করতে চায় বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর।
৩১ মার্চ শেষ হওয়া অর্থবর্ষে ভারত দিনপ্রতি ৪৭ লক্ষ ব্যারেল তেল আমদানি করেছে। তার ৩৫ শতাংশই আমদানি করা হয়েছে রাশিয়া থেকে। ২০২৩-২৪ সালে প্রতি দিন ভারতে এসেছে ১৬.৫ লক্ষ ব্যারেল রাশিয়ার তেল।
পশ্চিমি দেশগুলি রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক দিক থেকে অসহযোগিতা করলেও পাশে ছিল ভারত। তারা রাশিয়ার থেকে তেল আমদানি বন্ধ করেনি। বরং ভারতের জন্য তেল কেনায় বিশেষ ছাড় দিয়েছিল রাশিয়া।
রাশিয়া ভারতকে তেলের জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়ার কারণে দিল্লি রাশিয়া থেকে তেল কেনার পরিমাণও বাড়িয়ে দিয়েছিল। গত কয়েক মাসে রাশিয়ার তেলের ক্রেতাদের তালিকায় প্রথম সারিতে উঠে এসেছে ভারত।