দেশের আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতো প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও ক্রমশ ‘আত্মনির্ভর’ হয়ে উঠছে ভারত। এক সময় বিশ্বের উন্নত দেশগুলির অস্ত্রের জন্য মুখাপেক্ষী থাকা ভারত বর্তমানে বিশ্বের ৮৫টি দেশকে অস্ত্র বিক্রি করছে।
গত সোমবার ‘ফার্স্ট পোস্ট’-এর একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ জানিয়েছেন, বিভিন্ন দেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির অঙ্ক এ বারেই প্রথম ২১ হাজার কোটি টাকার অঙ্ক ছুঁয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ১৬ হাজার কোটি টাকার প্রতিরক্ষা সামগ্রী রফতানি করেছিল ভারত। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে সেই অঙ্ক ৩২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যাকে ‘আকর্ষণীয় উত্থান’ বলে অভিহিত করেছেন রাজনাথ।
রাজনাথ জানিয়েছেন, ভারতের লক্ষ্য ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে এই অঙ্ক ৩৫ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া। কেন্দ্রে মোদী সরকারের নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রতিরক্ষা সামগ্রী বিক্রির উপরে ভারত বিশেষ নজর দিয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি।
২০১৩-১৪ সালে অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে টাকার পরিমাণটা ছিল মাত্র ৬৮৬ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ সালে সেটাই পৌঁছল ২১ হাজার ৮৩ কোটি টাকায়।
ভারত যে ৮৫টি দেশে প্রতিরক্ষা সামগ্রীর জোগান দিচ্ছে, সেগুলির মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ইজ়রায়েলও। তা ছাড়াও মলদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরব, ফিলিপাইনস, পোল্যান্ড, চিলির মতো দেশ ভারতের কাছ থেকে অস্ত্র কিনছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে ভারতের ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্রের। তা ছাড়া ডর্নিয়ের-২২৮ যুদ্ধবিমান, রকেট লঞ্চার, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, রাতেও দেখা যায় এমন বাইনোকুলার, শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করা যায় এমন র্যাডার-সহ একাধিক সামগ্রী বিভিন্ন দেশকে বিক্রি করে ভারত।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ব্রাজ়িল, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, তাইল্যান্ডের মতো মোট ৩৪টি দেশকে বুলেট প্রতিরোধী জ্যাকেট সরবরাহ করে ভারত। ভারতের থেকে বন্দুকের গুলি কেনে ১০টি দেশ।
আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো দেশ আবার ভারত থেকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিন সামগ্রী কেনে। মরিশাস, মলদ্বীপ আবার দ্রুত গতির জলযান কেনে ভারতের কাছ থেকে। জলপথে শত্রুপক্ষকে ধাওয়া করে ধরার জন্য এই দ্রুত গতির জলযানগুলি কার্যকর।
ভারত এবং রাশিয়া যৌথ ভাবে তৈরি করেছে ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র। একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশ, সম্প্রতি ভিয়েতনাম এই ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে ইন্দোনেশিয়াও।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল) গত ডিসেম্বরে জানায়, তেজস যুদ্ধবিমান রফতানি করার বিষয়ে তারা আর্জেন্টিনা, ফিলিপাইনস, নাইজেরিয়া-সহ মোট ছ’টি দেশের সঙ্গে কথা বলছে। হ্যালের এক পদস্থ কর্তা জানিয়েছেন, তাঁদের লক্ষ্য আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অস্ত্র রফতানির অঙ্ক ২৫০০ কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ৬০০০ কোটির নতুন একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি অনুযায়ী, আর্মেনিয়ার হাতে নিজেদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী প্রযুক্তি তুলে দিতে সম্মত হয়েছে নয়াদিল্লি। এই প্রযুক্তির সাহায্য নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনস, মিশরও।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, তাঁরা চান ২০২৮-২৯ অর্থবর্ষের মধ্যে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের রফতানি বাণিজ্যকে ৩ লক্ষ কোটি টাকায় নিয়ে যেতে। অবশ্য এত কিছুর পরেও অস্ত্র বিক্রির নিরিখে বিশ্বের প্রথম পাঁচ দেশের তালিকায় এখনও ঢুকতে পারেনি ভারত।
অস্ত্র বিক্রির নিরিখে এখনও প্রথম স্থানে আমেরিকা। তারা গোটা বিশ্বে ৪২ শতাংশ অস্ত্রের জোগানদার। দ্বিতীয় স্থানে ফ্রান্স (১১ শতাংশ) এবং রাশিয়া (১১ শতাংশ)। তার পর আছে চিন (৫.৮ শতাংশ)।
অস্ত্র কেনার নিরিখে এখনও বিশ্বের পয়লা নম্বর দেশ ভারত। ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভারত গোটা বিশ্বের ৯.৮ শতাংশ অস্ত্র আমদানি করেছে।
ভারত অবশ্য এই পরনির্ভরতা ক্রমশ কমাতে চাইছে। দেশীয় প্রযুক্তিতে কিংবা অন্য দেশের সঙ্গে যৌথ ভাবে প্রতিরক্ষা সামগ্রী তৈরি করার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পাশাপাশি উৎসাহিত করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কাজে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকা বেসরকারি সংস্থাকেও।