যে প্রতিবেশীর সঙ্গে আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক, যাদের সঙ্গে সীমান্তে প্রায়ই গোলমাল বাঁধে, সেই পড়শি দেশের মুদ্রার উপরেই ভরসা করতে হচ্ছে ভারতকে! পড়শিদের মুদ্রা না হলে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
ভারতের উত্তর সীমান্তে রয়েছে চিন। তাদের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক কোনও কালেই খুব একটা সুমধুর নয়। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই চিনের মুদ্রাতেই বাণিজ্য করতে বাধ্য হচ্ছে ভারত।
রাশিয়া থেকে অনেক তেল কেনে ভারত। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স সূত্রে খবর, সেই রাশিয়ান তেলের আমদানিতেই ভারতের কয়েকটি সংস্থা চিনা মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহার করেছে।
রাশিয়ার তেল আমদানিকৃত দেশগুলির মধ্যে অন্যতম ভারত। বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রেই ভারতীয় সংস্থাগুলি ইউয়ানে তেল কিনতে বাধ্য হয়েছে বলে দাবি। তবে এ বিষয়ে কোনও সূত্রের পরিচয় প্রকাশ করেনি রয়টার্স।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া তাদের প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেন আক্রমণ করলে পূর্ব ইউরোপে বেজে উঠেছিল যুদ্ধের দামামা। সেই যুদ্ধ এখনও চলছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে চিনা মুদ্রার এই বাড়বাড়ন্ত।
ইউক্রেন আক্রমণের পর আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া রাশিয়ার উপর ক্ষুব্ধ হয়। আমেরিকা পুতিনের দেশের উপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যার প্রভাব পড়েছিল আন্তর্জাতিক বাজারে।
বিশ্ব জুড়ে এত দিন তেল কেনাবেচার মূল্য মাধ্যম ছিল আমেরিকান ডলার। রাশিয়া হোক বা রোমানিয়া, ডলারের মাধ্যমেই তেলের বাণিজ্য চলত। রাশিয়ার উপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার পর এই সমীকরণ বদলে যায়।
নতুন উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শুধু তেল নয়, রাশিয়ার সঙ্গে কোনও দেশের কোনও বাণিজ্যেই ডলার ব্যবহার করা যাবে না। ফলে বিকল্প বন্দোবস্ত করতে বাধ্য হয় বণিকমহল। অন্য দেশের মুদ্রায় বাণিজ্য শুরু হয়।
তবে এত দিন রাশিয়ার সঙ্গে তেলের কেনাবেচায় চিনের মুদ্রা ব্যবহার করেনি ভারত। রয়টার্স জানিয়েছে, আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভারতীয় সংস্থাগুলি দুবাইয়ের সংস্থার মাধ্যমে রাশিয়ার তেল কিনেছে।
সে ক্ষেত্রে, তেলের দাম দেওয়া হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মুদ্রা দিরহামে। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, রাশিয়ার তেলের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায় ডলার। কিন্তু বিক্রেতারা ডলার নিতে না চাইলে ইউয়ান বা দিরহামে দাম মেটাতে হয়।
ভারত থেকে সবথেকে বেশি রাশিয়ার তেল কেনে ইন্ডিয়ান অয়েল। তারাই রাশিয়ান তেলের সবচেয়ে বড় ভারতীয় ক্রেতা। জুন মাসে ইন্ডিয়ান অয়েল প্রথম রাশিয়ান তেলের দাম চিনের মুদ্রায় দিয়েছে।
রয়টার্স জানিয়েছে, ইন্ডিয়ান অয়েল ছাড়া আরও অন্তত দু’টি বেসরকারি তেল পরিশোধক সংস্থা রাশিয়ার তেলের জন্য চিনা ইউয়ানে খরচ করেছে। তবে বিষয়টির সংবেদনশীলতার কথা ভেবে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
রয়টার্সকে তাদের সূত্র জানিয়েছে, ইন্ডিয়ান অয়েল একাধিক তৈলবাহী জাহাজের জন্য ইউয়ানে খরচ করেছে। তবে ঠিক কতটা তেল ভারত থেকে এখনও পর্যন্ত ইউয়ানের মাধ্যমে কেনা হয়েছে, তা নিশ্চিত করে জানানো হয়নি।
আমেরিকান ডলারকে টপকে বিশ্বের নানা প্রান্তে তাদের মুদ্রার চল বৃদ্ধি করার মতলবে দীর্ঘ দিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছে চিন। বিশেষত, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার সুযোগে রাশিয়ান তেলের বাজারে ইউয়ানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা।
আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার পর ভারতের তরফে রাশিয়ার তেলের বিল ভারতীয় টাকার মাধ্যমে মেটানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়ার ব্যাঙ্কগুলি সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
গত মার্চে রয়টার্সের প্রতিবেদনেই বলা হয়েছিল, রাশিয়া থেকে তেল আমদানিতে চিনা মুদ্রার ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে ভারত। ইন্ডিয়ান অয়েলের মতো সংস্থার সাম্প্রতিক পদক্ষেপে ভারতের সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল আসছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমের দেশগুলি রাশিয়ার বিরোধিতায় আমেরিকার তালে তাল মিলিয়েছিল। কিন্তু ভারত এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে কোনও পক্ষ নেয়নি। শান্তি স্থাপনের কথা বললেও রাশিয়ার সরাসরি বিরোধিতা করেনি নয়াদিল্লি।
রাশিয়ার সঙ্গে তাই ভারতের সম্পর্কেরও তেমন অবনতি হয়নি কখনওই। দুই দেশের বাণিজ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানি মে মাসে প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।