পরিশোধিত পেট্রোপণ্য বিক্রিতে এ বার সৌদি আরবকেও হারিয়ে দিল ভারত। আত্মপ্রকাশ করল ইউরোপের সর্বাধিক জ্বালানি সরবরাহকারী দেশ হিসাবে। যার নেপথ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞাকেই দেখছেন আর্থিক বিশেষজ্ঞেরা। পাশাপাশি, এতে নয়াদিল্লির কোষাগার ফুলেফেঁপে উঠবে বলেও ভবিষ্যদ্বাণী করছেন তাঁরা।
মস্কোর অপরিশোধিত খনিজ তেলের উপর সম্প্রতি নতুন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইউরোপের অধিকাংশ দেশ। বাণিজ্যিক বিষয়ের সমীক্ষক সংস্থা ‘কেপলার’-এর দাবি, এতেই বিশ্বের জ্বালানি বাজার পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। ঘরোয়া বাজারে পেট্রোপণ্যের চাহিদা মেটাতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি রাশিয়ার বদলে এখন অনেকটাই ভারতের উপর নির্ভরশীল।
কেপলারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে ইউরোপের এই দেশগুলিতে দিনে পরিশোধিত খনিজ তেল আমদানির পরিমাণ ৩.৬০ লক্ষ ব্যারেল পেরিয়ে যাবে। ‘ব্রিকস’ সংগঠনের কোনও সদস্য রাষ্ট্র থেকে পশ্চিম ইউরোপ এত পেট্রোপণ্য আমদানি করবে তা আগে ভাবা যায়নি।
ঐতিহাসিক ভাবে সৌদি আরব বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক খনিজ তেল উৎপাদনকারী দেশ। সেই স্থান অবশ্য আরব দেশটি ধরে রেখেছে। কিন্তু খনিজ তেলে পরিশোধন করে তা বিশ্ব বাজারে বিক্রির নিরিখে সৌদিকে ছাপিয়ে গিয়েছে ভারত। যাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সেনা অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এর পরই মস্কোর থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে দেয় পশ্চিম ইউরোপের সমস্ত দেশ। পাশাপাশি চাপানো হয় বিপুল নিষেধাজ্ঞা। ওই বছর থেকেই জ্বালানি কেনার ব্যাপারে বিকল্প জায়গার সন্ধান শুরু করেছিল পশ্চিম ইউরোপ।
ইউরোপের বাজারের বিপুল চাহিদা টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আসরে নেমে পড়ে ভারত। রাশিয়ার থেকে কম দামে খনিজ তেল আমদানি করা শুরু করে নয়াদিল্লি। সেই তেল পরিশোধনের পর ইউরোপের বাজারে রফতানি করছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলি। পরিশোধনের ফলে রাশিয়ার তেলের গুণগত মানেরও পরিবর্তন হয়েছে বলে কিছু কিছু রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে।
সংবাদ সংস্থা ‘রয়টার্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ইউরোপের দেশগুলির ভারত থেকে দৈনিক পরিশোধিত তেল আমদানির পরিমাণ ছিল ১.৫৪ লক্ষ ব্যারেল। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুধুমাত্র ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন’ ভুক্ত দেশগুলির নয়াদিল্লির থেকে দৈনিক পরিশোধিত পেট্রোপণ্য কেনার মাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল দু’লক্ষ ব্যারেল।
সমীক্ষক সংস্থাটি জানিয়েছে, ইউরোপের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে রাশিয়ার থেকে অপরিশোধিত তেলে আমদানির পরিমাণ আরও বাড়াবে ভারত। আগামী বছরের (২০২৫) এপ্রিলের মধ্যে মস্কোর থেকে দিনে ২০ লক্ষ ব্যারেল ‘তরল সোনা’ কিনবে নয়াদিল্লি। যা ভারতের মোট তেল আমদানির ৪৪ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভারতের হাতে খনিজ তেল পরিশোধনের যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা যথেষ্ট উন্নত মানের। কম দামের রাশিয়ান তেলকে ইউরোপের বাজারের উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন জ্বালানিতে পরিণত করা মোটেই সহজ নয়। কিন্তু সেটা খুব সহজেই করতে সক্ষম হয়েছে নয়াদিল্লি।
চলতি বছরের গোড়ায় মস্কো সফরে গিয়ে এই ইস্যুতে মুখ খোলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ব যখন জ্বালানি সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল, তখনই ভারত পরিশোধিত তেল নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ইউরোপের পেট্রল এবং ডিজেল-সহ পেট্রোপণ্যের চাহিদা আমরা পূরণ করেছি।’’
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়ার থেকে ভারতের অপরিশোধিত তেল কেনাকে মোটেই ভাল চোখে দেখেনি পশ্চিমি বিশ্ব। মস্কো সফরে তারও জবাব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘আপনাদের এটা মানতেই হবে যে, ভারত-রাশিয়ার তেল চুক্তি ইউরোপের জ্বালানির বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করেছে।’’
অন্য দিকে, রাশিয়ার থেকে সস্তা দরে অপরিশোধিত তেল কেনায় মোটা টাকা সাশ্রয় হয়েছে কেন্দ্রের। সূত্রের খবর, ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ৭০০ কোটি ডলার বাঁচাতে পেরেছে নয়াদিল্লি। পাশাপাশি এই বাণিজ্য রাশিয়া এবং ভারতের স্থানীয় মুদ্রায় হওয়ায় তার সুবিধাও পেয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
এই পরিস্থিতিতে তেল উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াতে শুরু করে দিয়েছে সৌদি আরবও। চলতি বছরের ডিসেম্বরে আরব দেশটির নেতৃত্বাধীন তেল উত্তোলক রাষ্ট্রগুলির সংগঠন ‘ওপেক প্লাস’ দিনে ১ লক্ষ ৮০ হাজার ব্যারল অতিরিক্ত তরল সোনা আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। ২০২৫ সালে এই পরিমাণ আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
তেল উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে সৌদি আরবের রাজপরিবার যে অচিরেই টাকার বৃষ্টি দেখতে পাবে, তা বলাই বাহুল্য। ফলে তরল সোনা রফতানিতে পুরনো জায়গা ফিরে পেতে জাহাজ নির্মাণ এবং কেনার দিকে নজর দিয়েছে এই আরব রাষ্ট্র।
সম্প্রতি গ্রিসের ‘ক্যাপিটাল মেরিটাইম অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন’-এর সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে সৌদির জাতীয় শিপিং সংস্থা ‘বাহারি’। ন’টি বড় ক্রুড ক্যারিয়ার কেনার জন্য এই চুক্তি হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। যা সৌদির তেল রফতানির পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার পথ সুগম করবে।
রাশিয়ার মতো ভেনেজুয়েলা এবং ইরানের উপরেও খনিজ তেল বিক্রির ক্ষেত্রে রয়েছে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা। যা এড়িয়ে এই দু’টি দেশ থেকে কী ভাবে তরল সোনা আমদানি করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছে নয়াদিল্লি। তেহরান অবশ্য তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সস্তা দরে বিক্রির ব্যাপারে আগ্রহী বলে জানিয়ে দিয়েছে।