ইসলামাবাদে ফের ক্ষমতাবদল? জেলবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে এ বার কুর্সিতে বসাবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প? সেই লক্ষ্যে ‘পথের কাঁটা’ পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে রাস্তা থেকে সরানোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে তাঁর সরকার। ফলে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটি আবার রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়তে চলেছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
চলতি বছরের ২৪ মার্চ মার্কিন পার্লামেন্ট কংগ্রেসে ‘পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক অ্যাক্ট’ শীর্ষক একটি বিল পেশ করেন রিপাবলিকান নেতা জো উইলসন। বিলটি সমর্থন করেন কংগ্রেসের আর এক সদস্য জিমি প্যানেটা। সংশ্লিষ্ট বিলে পাক সেনাপ্রধান জেনারেল মুনিরের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর দাবি তুলেছেন তাঁরা।
আমেরিকার আইন অনুযায়ী, এই বিল পাশ হলে যুক্তরাষ্ট্র সফরের জন্য ভিসা পাবেন না জেনারেল মুনির। পাশাপাশি, আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’ দেশটিতে তাঁর যা যা সম্পত্তি রয়েছে, সে সব বাজেয়াপ্ত করতে পারবে ট্রাম্প প্রশাসন। তবে ইমরান-সহ সমস্ত ‘রাজনৈতিক বন্দি’দের পাক সরকার মুক্তি দিলে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে পারে ওয়াশিংটন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ উইলসন রিপাবলিকান দলের নীতি নির্ধারক কমিটির সদস্য। মার্কিন সরকারের ‘পররাষ্ট্র ও সশস্ত্র বাহিনী কমিটি’কে (ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড আর্মড সার্ভিসেস কমিটি) নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জেলবন্দি ইমরানের মুক্তির দাবিতে সুর চড়িয়ে আসছেন তিনি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী’ সরকারি পদস্থ কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপাতে বিশেষ একটি আইনের সাহায্য নিয়ে থাকে আমেরিকা। ২০১৬ সালে পাশ হওয়া ওই আইনটি হল, ‘গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি হিউম্যান রাইট্স অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যাক্ট’। এরই আওতায় উইলসন জেনারেল মুনিরের উপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত বিলটি এনেছেন বলে জানা গিয়েছে।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম বার ইমরানকে নিয়ে গলা চড়ান ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ উইলসন। ‘অন্যায় ভাবে’ সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে গরাদের পিছনে পাঠানো হয়েছে বলে মন্তব্য করে, চাঁছাছোলা ভাষায় পাক ফৌজের কড়া সমালোচনা করেন তিনি। ইমরানকে অবিলম্বে ‘রাজনৈতিক বন্দি’ ঘোষণার দাবি জানান এই রিপাবলিকান নেতা।
২০২৩ সালে অগস্টে ইমরানকে গ্রেফতার করে পাক সরকার। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং আর্থিক নয়ছয়ের একাধিক মামলা রয়েছে। জেলবন্দি থাকার ফলে কোনও ভাবেই নির্বাচনে যোগ দিতে পারবেন না ১৯৯২ এক দিনের বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট দলের কিংবদন্তি অধিনায়ক। তাঁকে আইনি মামলায় জড়ানোর নেপথ্যে জেনারেল মুনিরের মস্তিষ্ক কাজ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পাক সেনাপ্রধানের উপর নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি মার্কিন কংগ্রেসে পেশ হওয়া বিলটিতে পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ওয়াশিংটন। এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞা মূল্যায়নের জন্য ৩০ দিন ধার্য করা হয়েছে। জেনারেল মুনিরের সঙ্গে সেনার একাধিক পদস্থ কর্তা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের উপরেও নিষেধাজ্ঞার কোপ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০১৮ সালে পাক প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’ বা পিটিআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ইমরান। এর এক বছর আগেই প্রথম বারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ট্রাম্প। বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতার সঙ্গে বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল সাবেক পাক ক্রিকেট অধিনায়ক তথা রাজনীতিকের।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আমেরিকা সফর করেন ইমরান। ওই সময়ে তাঁকে ‘মহান অ্যাথলিট’ বলে সম্বোধন করেছিলেন বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই বদলে যায় পরিস্থিতি। ২০২১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন জো বাইডেন। সাবেক পাক প্রধানমন্ত্রীকে অত্যন্ত অপছন্দ করতেন তিনি। ফলে ইমরানের সঙ্গে ফোনে পর্যন্ত কথা বলতেন না তিনি।
বাইডেন জমানায় ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় ‘রাজনৈতিক রিভার্স সুইং’য়ের আশ্রয় নেন ইমরান। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ায় গিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। ঠিক ওই দিনই ইউক্রেন আক্রমণ করে বসে মস্কো। এতে আমেরিকার চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন পিটিআইয়ের শীর্ষনেতা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, এর পরই বাইডেন প্রশাসন পাক প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি থেকে ইমরানকে সরিয়ে ফেলার নীল নকশা ছকে ফেলে। পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে পিটিআইয়ের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। ফলে একজোট হয়ে ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন বিরোধীরা।
২০২২ সালের এপ্রিল মাসে অনাস্থাকে কেন্দ্র করে পাক পার্লামেন্ট ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে ভোটাভুটি হয়। এতে পতন ঘটে ইমরানের সরকারের। নিন্দকেরা অবশ্য বলেন, গোটা চিত্রনাট্যটাই ছিল আমেরিকার সাজানো। পিটিআই নেতা কুর্সি থেকে সরতেই সেখানে চড়ে বসেন ‘পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ়’-এর (পিএমএল-এন) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শাহবাজ় শরিফ।
উল্লেখ্য, ক্ষমতায় থাকাকালীন জেনারেল মুনিরের সঙ্গে ইমরানের সম্পর্ক ছিল ‘সাপে নেউলে’। মুনিরকে সেনাপ্রধানের পদ দিতে গররাজি ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। শাহবাজ় প্রধানমন্ত্রী হতেই সেই রাস্তা খুলে যায়। অন্য দিকে সরকার ফেলার ‘ষড়যন্ত্রের’ নেপথ্যে মুনিরের হাত রয়েছে বলে প্রকাশ্য জনসভায় বলতে শুরু করেন ইমরান।
তবে পিটিআই নেতা ক্ষমতাচ্যুত হতেই দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করে শাহবাজ় সরকার। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল জমি কেলেঙ্কারি এবং তোষাখানা মামলা। কিন্তু এতেও ইমরান দমে যাননি। পাল্টা সরকার-বিরোধী মিছিল ও জনসভার পরিমাণ বাড়িয়ে দেন তিনি।
২০২২ সালের নভেম্বরে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে মিছিল করার সময়ে গুলিবিদ্ধ হন সাবেক পাক প্রধানমন্ত্রী। বুলেটে এ ফোঁড়-ও ফোঁড় হয়ে যায় তাঁর পা। কিন্তু প্রাণ বেঁচে যান ইমরান। ওই ঘটনার পর সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির তাঁকে খুনের ষড়যন্ত্র করেছেন বলে আরও সুর চড়ান পিটিআই প্রতিষ্ঠাতা।
ইমরানের তোলা যাবতীয় অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করে সেনা। ২০২৩ সালের মে মাসে ইসলামাবাদ হাই কোর্ট চত্বর থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে পাক রেঞ্জার্স। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঠাঁই হয় জেলে। গ্রেফতারির বিরুদ্ধে একাধিক আদালতে আবেদন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু শত চেষ্টা করেও গরাদের বাইরে পা রাখতে পারেননি তিনি।
এ হেন ইমরানকে মুক্ত করতে কেন এত আগ্রহী ট্রাম্প প্রশাসন? বিশ্লেষকদের দাবি, পাকভূমি ব্যবহার করে ইরান এবং আফগানিস্তানের উপর কড়া নজর রাখতে চায় ওয়াশিংটন। আর তাই ইসলামাবাদের কুর্সিতে ‘পুতুল শাসক’কে বসাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র।