রাজতন্ত্র এবং হিন্দু রাষ্ট্রের দাবিতে অগ্নিগর্ভ নেপাল। রাজধানী কাঠমান্ডু এবং তার সংলগ্ন এলাকায় চলছে দেদার লুটপাট। একের পর এক দোকান ভাঙচুর এবং গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে উন্মত্ত জনতা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমালয়ের কোলের দেশটির রাস্তায় টহল দিচ্ছে সেনা। কিন্তু তাতে যে গণবিক্ষোভে দাঁড়ি পড়েছে, এমনটা নয়।
২০০৮ সালে সংবিধান সংশোধন করে নেপালে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। ২০১৫ সালে অনুমোদিত হয় নতুন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সংবিধান। তার আগে হিমালয়ের কোলের দেশটি ছিল বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র। ১৭ বছর আগে ছুড়ে ফেলা জুতোয় নেপালবাসীর ফের পা গলাতে চাওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
নেপালবাসীর রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবির সবচেয়ে জোরালো কারণ হিসাবে প্রথমেই আসবে স্থায়ী সরকারের কথা। ২০০৮ সাল থেকে কাঠমান্ডুতে মোট ১৩টি সরকার শপথ নিয়েছে। কিন্তু কোনওটাই বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ফলে দুর্বল হয়েছে সেখানকার প্রশাসনিক কাঠামো। শুধু তা-ই নয়, এর জেরে সরকারি পরিষেবা ঠিকমতো মিলছে না বলে আমজনতার অভিযোগ রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বার বার পতন হওয়ায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে নেপালবাসীর মনে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। এর কার্যকারিতা নিয়ে হতাশ তাঁরা। তৃতীয়ত, রাজতন্ত্রের বিলুপ্তির পর থেকেই সরকারি স্তরে বেড়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। গণবিক্ষোভের জন্য একে সবচেয়ে বেশি দায়ী করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
চতুর্থত, রাজতন্ত্রের পতনের পর থেকে গত দেড় দশকে ক্রমশ দুর্বল হয়েছে নেপালের অর্থনীতি। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, বছর কয়েক আগে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের (ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) কাছে হাত পাততে হয় হিমালয়ের কোলের দেশটিকে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেই ঋণ শোধ করতে পারেনি কাঠমান্ডু।
আইএমএফের থেকে নেপালের নেওয়া ঋণের অঙ্ক ৪ কোটি ১৮ লক্ষ ডলার। ওই অর্থ শোধ করার জন্য কাঠমান্ডুকে অতিরিক্ত চার বছর সময় দিয়েছে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেই সময়সীমার মধ্যেও ‘এভারেস্ট-রাষ্ট্র’ ঋণ মেটাতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
আর্থিক দিক থেকে দুর্বল হওয়ায় নেপালে মুদ্রাস্ফীতির হার আকাশ ছুঁয়েছে। গত বছর ভোক্তা মুদ্রাবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৩ শতাংশ। ফলে আগুনে দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হয়েছে সেখানকার বাসিন্দাদের। পাশাপাশি, রাজতন্ত্র চলে যাওয়ার পর গণতান্ত্রিক সরকার স্থলবেষ্টিত দেশটিতে সে ভাবে কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি।
১৭৬৮ সালে এভারেস্টভূমিতে রাজবংশের সূচনা হয়। নেপালের শেষ রাজা ছিলেন জ্ঞানেন্দ্র। ২০০৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। তার পর থেকে সাধারণ নাগরিক হিসাবে হিমালয়ের কোলের দেশটিতে বাস করছেন তিনি। তাঁর কোনও রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই। অনুমতি নেই রাজপ্রাসাদে যাওয়ার। এমনকি কোনও সরকারি সুযোগ-সুবিধাও পান না সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র।
২৪০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত নেপালি রাজপরিবারে ২০০১ সালে পড়ে শনির কুদৃষ্টি। ওই সময়ে কাঠমান্ডুর সিংহাসনে ছিলেন জ্ঞানেন্দ্রের দাদা রাজা বীরেন্দ্র। তিনি ছিলেন পৃথ্বীনারায়ণের নবম প্রজন্ম। ওই বছরের জুন মাসে হঠাৎ করেই বীরেন্দ্র-সহ পরিবারের প্রায় সবাইকে গুলি করে হত্যা করেন যুবরাজ দীপেন্দ্র। এর পর তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
রাজবাড়ির ভিতরে নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার হন যুবরাজ দীপেন্দ্র। পরে মৃত্যুশয্যাতে তাঁর অভিষেক করা হয়। কিন্তু দীপেন্দ্র প্রাণে বাঁচেননি। এর পর কাঠমান্ডুর সিংহাসনে বসেন জ্ঞানেন্দ্র। ওই সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মাওবাদী সমস্যা তুঙ্গে ওঠে।
কুর্সিতে বসে জ্ঞানেন্দ্র কড়া হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলার দিকে নজর দেন। নেপালি পার্লামেন্টের ক্ষমতা খর্ব করেন তিনি। ২০০৫ সালে গণতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়ে যাবতীয় ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন জ্ঞানেন্দ্র। কিন্তু এতে ফল হয় হিতে বিপরীত। স্বৈরাচারী তকমা সেঁটে যায় রাজার গায়ে।
জ্ঞানেন্দ্র পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার পর কাঠমান্ডুতে আছড়ে পড়ে গণ আন্দোলনের ঢেউ। ক্ষমতা দখল করতে তাতে হাওয়া দিয়েছিল মাওবাদী এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ বার গণবিক্ষোভ রাস্তায় নেমে এসেছে তাঁকে ‘সিংহাসনে’ ফেরানোর দাবিতে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এক ভিডিয়োবার্তায় দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর জন্য নেপালবাসীর কাছে আবেদন জানান জ্ঞানেন্দ্র। এ মাসের গোড়ায় দেশের পশ্চিমাঞ্চল সফর শেষ করে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফেরেন তিনি। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানান বিপুলসংখ্যক জনতা।
ওই দিনই ‘আমরা আবার রাজতন্ত্র চাই’ বলে সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্রর সামনে স্লোগান দেয় নেপালবাসী। হুডখোলা জিপে তাঁকে নিয়ে মিছিল করে আমজনতা। পাশাপাশি ওঠে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ ঘোষণার দাবি। জ্ঞানেন্দ্রকে ফের রাজপ্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন তাঁরা।
এই পরিস্থিতিতে নেপালে রাজাকে ফেরানোর দাবিতে সুর চড়িয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি এবং গণতন্ত্রপন্থী নেপালি কংগ্রেসের সমর্থকদের একাংশ। তবে এই দুই দল ‘প্রতীকী রাজতন্ত্রের’ প্রত্যাবর্তন চাইছে। অন্য দিকে গত ২৮ মার্চ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা মাওবাদী নেতা প্রচণ্ড (পুষ্পকমল দহাল) এর বিরোধিতায় জনসভা থেকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিলে এভারেস্টভূমিতে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৯ মার্চ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জ্ঞানেন্দ্রের সমর্থকদের মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়। এর পর পরিস্থিতি আরও অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। রাজধানী কাঠমান্ডুতে জায়গায় জায়গায় পুলিশ-জনতা খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। চলে দেদার পাথরবৃষ্টি এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কার্যালয়ে ভাঙচুর।
প্রচণ্ডের দল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) রাজতন্ত্র ফেরানোর দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। হুঁশিয়ারির সুরে প্রচণ্ড বলেছেন, ‘‘জ্ঞানেন্দ্র যদি সিংহাসনে বসেন, তা হলে তিনি বড় রকমের বোকামি করবেন। এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে তাঁকে।’’
বর্তমানে কাঠমান্ডুর কুর্সিতে রয়েছেন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনিফায়েড মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) চেয়ারম্যান কেপি শর্মা ওলি। তাঁর বিরুদ্ধে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। পার্লামেন্টের ভিতরে এবং বাইরে ওলির বিরুদ্ধে মূল রাজনৈতিক বিরোধীর দায়িত্ব পালন করছেন প্রচণ্ড।
কাঠমান্ডু পোস্টের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ক্ষমতার শীর্ষে যাওয়া প্রচণ্ড বা ওলি নীতিগত ভাবে রাজতন্ত্রের বিরোধী। কিন্তু, নেপালবাসীর বড় অংশই রাজাকে ফেরত চাইছেন। সেই সংখ্যা ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছে। ফলে একে কেন্দ্র করে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞেরা।