একের পর এক সমাধি খুঁড়ে পাওয়া গেল সারি সারি সাদা পুঁতি। কিন্তু সেগুলো যে-সে পুঁতি নয়। সবগুলোই হাতে তৈরি করা। পুঁতিগুলোর বয়স কয়েক হাজার বছর।
২০০৮ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা স্পেনের সেভিয়ায় প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে নির্মিত এই সমাধিস্থলটি আবিষ্কার করেছিলেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে গবেষকেরা সেই সমাধি খনন করে ২ লক্ষ ৭০ হাজারেরও বেশি পুঁতি পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এর আগে কোথাও এত পুঁতি একসঙ্গে পাওয়া যায়নি। মন্টেলিরিও থোলোস সমাধিস্থলটি হল এখনও পর্যন্ত পাওয়া বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় পুঁতির সংগ্রহস্থল।
সংগৃহীত পুঁতিগুলিকে দেখতেও আর পাঁচটা সাধারণ পুঁতির থেকে অন্য রকম। চ্যাপ্টা আকৃতির পুঁতিগুলোর মাঝে রয়েছে একটি করে ছিদ্র। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, সেই পুঁতিগুলি মূলত ঝিনুকের খোলা, হাড় এবং পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল।
এই একই ধরনের পুঁতি মন্টেলিরিও সমাধিস্থল থেকে ১০০ মিটার দূরে অবস্থিত ‘আইভরি লেডি’র সমাধিতেও পাওয়া গিয়েছিল।
‘আইভরি লেডি’র সমাধিতে কঙ্কালের সঙ্গে ছিল হাতির দাঁত, হাতির দাঁতের তৈরি চিরুনি, স্ফটিক ও পাথরের কুঠার, অস্ট্রিচের ডিমের খোলস। তা থেকে গবেষকেরা মনে করেছিলেন, সমাধিটি গুরুত্বপূর্ণ কোনও নেতার। পরে সেই ধারণা সম্পূর্ণ বদলে যায়। সাহায্য করেছিল নতুন এক পদ্ধতি।
প্রথমে হাড়গুলিকে পরীক্ষা করে গবেষকেরা জানিয়েছিলেন যে, সেগুলি কোনও পুরুষের। কিন্তু পরবর্তী কালে আবার পরীক্ষা করে গবেষকেরা জানতে পারেন যে, সেগুলি কোনও মহিলার। ২০২১ সালে নতুন এক পদ্ধতি মেনেই সেই তথ্য প্রকাশ্যে আসে। তার পরেই ইতিহাসের অনেক অজানা রহস্যের সমাধান হয়।
সেভিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিয়োনার্দো গার্সিয়া সানজুয়ান ছিলেন ওই গবেষকদলে। তিনি জানান, ওই আবিষ্কারের পরেই ওই মহিলা এবং সেই আমলের সমাজ সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের ধারণা বদলে যায়। তিনি জানিয়েছেন, আগে কোনও কঙ্কালের সঙ্গে ধারালো অস্ত্র মিললে ধরে নেওয়া হত, সেটি কোনও পুরুষের। নতুন এই আবিষ্কারের পর সেই ধারণাতেই ধাক্কা লাগে। লিঙ্গবৈষম্যের গোড়ায় আঘাত করেছিল সেই আবিষ্কার।
গার্সিয়া জানিয়েছেন, মন্টেলিরিও সমাধিটি হয়তো ‘আইভরি লেডি’র বংশধরদের জন্যই বানানো হয়েছিল। যদিও ‘আইভরি লেডি’র সঙ্গে মন্টেলিরিও সমাধিতে সমাহিত ব্যক্তিদের কোনও সম্পর্ক রয়েছে কি না তা এখনও পরীক্ষা করা হয়নি। পরবর্তী কালে সেটা নিয়েও গবেষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন গার্সিয়া।
কিন্তু সমাধির মধ্যে এই পুঁতিগুলো এল কোথা থেকে? গবেষকদল সেই সমাধির একটি কক্ষে পাওয়া ২০টি কঙ্কালের লিঙ্গ নির্ধারণ করার জন্য তাঁদের হাড় পরীক্ষা করেছিলেন। ২০টির মধ্যে ১৫টি কঙ্কালের সঙ্গেই মহিলাদের দেহের কঙ্কালের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। বাকি পাঁচ জনের লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়নি। অন্য একটি কক্ষে দুই মহিলার কঙ্কালের সঙ্গেও এই রকম অনেক পুঁতি পাওয়া গিয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অনুমান করছেন, স্পেনের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত মন্টেলিরিও থোলোস সমাধিস্থলে তাম্রযুগের বহু মহিলার দেহ সমাধিস্থ করা হয়ছিল। সেই সময় সুতোর সাহায্যে এই বিশেষ পুঁতিগুলো গেঁথে পোশাক বানিয়ে সেটি পরিয়ে সমাধি দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা আরও অনুমান করছেন যে, হয়তো সেই সময়ের মহিলারা এই পুঁতি দিয়ে তৈরি পোশাক পরতেন।
যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং গবেষণার সহ-লেখক মার্তা ডিয়াজ-গার্ডামিনো বলেছেন, অনেক পুঁতি সারিবদ্ধ ভাবে দেখা গিয়েছে যা দেহের বড় অংশকে ঢেকে রেখেছিল।
গার্সিয়া জানিয়েছেন, এই পুঁতিগুলো দিয়ে তৈরি পোশাকগুলি অত্যন্ত ভারী ছিল। সেই থেকে বলা যেতে পারে, এই পোশাকগুলি তাঁরা প্রতি দিন পরতেন না। সামাজিক বা ধর্মীয় কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে সেই সময়ের মহিলারা এই সকল পোশাক পরতেন। তাই তাঁদের সম্মান জানাতে মৃত্যুর পর সেই পোশাক পরিয়ে সমাধি দেওয়া হত।
মন্টেলিরিও পুঁতির গবেষণা ইউরোপে তাম্রযুগীয় সমাজের উপর গবেষণায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই সমাধিগুলি খতিয়ে দেখে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মনে করছেন, সে সময় সমাজকে নেতৃত্ব দিতেন মহিলারা। প্রসঙ্গত, ওই সময় থেকেই ইউরোপে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের উদ্ভব হয়।
গবেষকদের মতে, পুঁতিগুলো তৈরি করা যথেষ্ট পরিশ্রমের। আনুমানিক, ১০ জন লোক মিলে প্রায় সাত মাস ধরে প্রতি দিন আট ঘণ্টা ধরে কাজ করে এই পুঁতিগুলো তৈরি করেছেন।
রেডিয়ো কার্বন ডেটিং পদ্ধতির দ্বারা পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে, এই পুঁতিগুলোর বয়স সমাধিস্থ মহিলাদের মৃত্যুর বয়সের সমসাময়িক। অর্থাৎ, তাঁদের সমাধি দেওয়ার আগেই পুঁতিগুলো বানানো হয়েছিল এবং তার পর তা দিয়ে পোশাক তৈরি করে সেগুলি পরিয়ে তাঁদের সমাধি দেওয়া হয়েছিল।
মন্টেলিরিও সমাধির অন্য কক্ষে পাওয়া দুই মহিলার কঙ্কালে পুঁতিগুলি টিউনিকের আকারে বিস্তৃত ছিল। সেখান থেকে ধারণা করা যায় যে, অন্য নারীদের তুলনায় সমাজে এই দুই নারীর স্থান উচ্চ ছিল। এঁদের মধ্যে এক জনের হাত ধর্মীয় ভঙ্গিতে উঁচু করে রাখা হয়েছিল। সেটি থেকে ধারণা করা যায় যে তিনি সমাজে নেতৃত্ব দান করতেন বা পুরোহিত ছিলেন।
তবে অনেক গবেষকই মনে করেন, মহিলার সমাধি থেকে সে সময়ের সমাজ নিয়ে পুরোপুরি ধারণা করে নেওয়া ঠিক হবে না। অধ্যাপক-গবেষক রেবেকা গোল্যান্ড জানিয়েছেন, মহিলাদের সে সময় অনেক বেশি সম্মান ছিল, তা ভাবাও ঠিক হবে না। এমনও হতে পারে, সে সময় লিঙ্গভেদ ছিল না। দুই লিঙ্গের মধ্যে সে ভাবে ফারাক করা হত না। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ববিদেরা নিশ্চিত যে, সেই সময়ে এই পুঁতিগুলো বানাতে যথেষ্ট পরিমাণ সামুদ্রিক কাঁচামালের প্রয়োজন পড়েছিল যা যথেষ্ট ব্যয়বহুল ছিল। পুঁতিগুলি তৈরি করতেও যথেষ্ট শ্রমের প্রয়োজন পড়েছিল।