গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ, মূলত এপ্রিল-মে মাসে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মাঝেমাঝে বিকেল কিংবা সন্ধ্যার দিকে বজ্র, বিদ্যুৎ-সহ যে প্রচণ্ড ঝড়-ঝঞ্ঝার সৃষ্টি হয়। তাকে কালবৈশাখী বলে।
‘কাল’ শব্দটির অর্থ প্রলয় কিংবা ধ্বংস। আর মূলত বৈশাখ মাসে এই ঝড় হয় বলে একে কালবৈশাখী নামে অভিহিত করা হয়। অনুরূপ ঝড়কে বিহারে আঁধি ও অসমে বরদইছিলা বলা হয়।
পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, অসমের কিছু এলাকা ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কালবৈশাখী হয়।
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ-সহ পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী ও পুকুর। গ্রীষ্মকাল অর্থাৎ, মূলত এপ্রিল-মে মাসে দিনের বেলা প্রখর সূর্যকিরণের তাপে এই সব জলাশয় ও নদীর জল বাষ্প হয়ে উপরে উঠে যায়। ফলে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ থাকে অত্যন্ত বেশি।
পাশাপাশি, প্রখর তাপে স্থানীয় ভাবে শক্তিশালী নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। এই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বায়ু নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসে। এ রকম বিপরীতধর্মী বায়ুপ্রবাহ মুখোমুখি হলে সংঘর্ষের ফলে ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়।
গরম, আর্দ্র বাতাস সোজা উপরের দিকে উঠে গিয়ে শীতল হয়ে এক বিশেষ ধরনের মেঘ তৈরি করে। এই মেঘের নাম কিউমুলোনিম্বাস। এই মেঘের রং কালচে। তাই কালবৈশাখীর সময়ে কালো হয়ে আসে আকাশ।
ভূমি ও জলাশয় সারা দিন উত্তপ্ত হয় বলেই বিকেলের দিকে কালবৈশাখী সৃষ্টি হয়। অন্যান্য ঝড়ের সঙ্গে কালবৈশাখীর মূল পার্থক্যই হল কাল বৈশাখীতে ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সময়ে বিদ্যুত চমকায়।
সাধারণত স্বল্পস্থায়ী হলেও কালবৈশাখী কিন্তু খুবই শক্তিশালী। কালবৈশাখীর গড় গতিবেগ থাকে ঘণ্টায় প্রায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। তবে কখনও কখনও ঝড়ের বেগ ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটারও হয়ে যেতে পারে।
কালবৈশাখীর ফলে যে বৃষ্টিপাত হয় তাতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের উষ্ণতা এক ধাক্কায় প্রায় পাঁচ থেকে দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যেতে পারে। ফলে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরম থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি মেলে। দেখা মেলে শিলাবৃষ্টিরও।
এক বার কালবৈশাখী হলে ফের এই ঝড় তৈরির সুযোগ তৈরি হয়। কারণ আর কিছুই নয়, ঝড়ের সঙ্গে হওয়া বৃষ্টিতে জলাশয়গুলি পূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে বাষ্প তৈরি হয় বেশি। যত বেশি বাষ্প তৈরি হবে, তত বেশি বাড়বে কালবৈশাখীর সম্ভবনা।
প্রবল ঝড়ে কখনও কখনও ধন-প্রাণের ক্ষতি হলেও জলবায়ুর দিক থেকে কালবৈশাখীর গুরুত্ব অপরিসীম। পাশাপাশি, ঝড় যদি অল্প হয়, তবে সেই বৃষ্টিতে আম ও পাটের ফলন ভাল হয়।
বাঙালির সাহিত্য সংস্কৃতিতেও কালবৈশাখী ফিরে এসেছে বার বার। রবিঠাকুর থেকে নজরুল, একাধিক গান ও কবিতায় তুলে এনেছেন কালবৈশাখীর কথা। উদাত্ত কণ্ঠে গান ধরেছেন জর্জ বিশ্বাস কিংবা কলিম শরাফিরা।
সত্যজিৎ কখনও সেই ঝড় তুলে এনেছেন চারুলতায়। কখনও ঝড়ের রাতে ঋত্বিক ঘর ছাড়া করেছেন নীতাকে।
প্রাচীন কালের খনার বচনেও মেলে এই ঝড়ের উল্লেখ। ‘‘চৈত্রেতে থর থর/বৈশাখে ঝড় পাথর/জ্যৈষ্ঠেতে তারা ফুটে/তবে জানহ বর্ষা বটে।’’