ঋণ বাড়ছে সরকারের। যদি ঋণের পরিমাণ এ ভাবেই বাড়তে থাকে, তা হলে তা দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি)-কেও টপকে যেতে পারে। বিপদে পড়তে পারে ভারত! এমনই তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (আইএমএফ)-এর রিপোর্টে। গত বছরের ডিসেম্বরে সেই রিপোর্ট প্রকাশ্যে এসেছে।
সংবাদমাধ্যম ‘বিজ়নেস স্ট্যান্ডার্ড’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতকে সতর্ক করে আইএমএফ জানিয়েছে, ভারতীয় সরকারের ঋণের পরিমাণ দেশের জিডিপি অর্থাৎ, ৩.১৮ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমনটা যদি হয় তা হলে বিশ বাঁও জলে পড়তে হতে পারে ভারতকে। কারণ, জলবায়ু পরিস্থিতি উন্নত করতে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত কারণে ভারতের এখন প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। আর তাই যদি সরকারের ঋণ জিডিপিকে ছাড়িয়ে যায়, তা হলে অর্থনীতি সংক্রান্ত ঝুঁকি বাড়তে পারে।
আইএমএফ তাদের এক বার্ষিক রিপোর্টে লিখেছে, ‘‘দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি বেশি কারণ, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছতে এবং জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিস্থিতি উন্নত করতে ভারতের এখন প্রচুর অর্থ প্রয়োজন৷ পাশাপাশি বৃহত্তর বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে।’’
চুক্তিবদ্ধ সদস্য দেশগুলির তহবিল সংক্রান্ত বিষয়ে নজর রেখে আইএমএফ এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
যদিও আইএমএফের এই রিপোর্ট নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছে ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকার। কেন্দ্রের যুক্তি, ঋণ নিয়ে দেশের ঝুঁকি খুব কম কারণ সার্বভৌম ঋণ মূলত দেশীয় মুদ্রায় রয়েছে।
আইএমএফে ভারতীয় এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর কেভি সুব্রক্ষ্মণ্যমও আইএমএফের অনুমানের সঙ্গে মতানৈক্য প্রকাশ করেছেন। তাঁর দাবি, ভারতের ‘ডেট-টু-জিডিপি’ অনুপাত (কোনও দেশের ঋণ এবং জিডিপির অনুপাত) খুব সামান্যই বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুব্রক্ষ্মণ্যম বলেন, ‘‘দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ঝুঁকি বেশি। তবে ভারতের সার্বভৌম ঋণের ঝুঁকি খুবই কম কারণ, এটি প্রধানত দেশের মুদ্রায় নেওয়া ঋণ। গত দুই দশকে বিশ্ব অর্থনীতি বহু বিপদের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও ভারতের সরকারি ডেট-টু-জিডিপি অনুপাত ২০০৫-০৬ সালে ৮১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১-২২ সালে ৮৪ শতাংশ হয়েছিল। তবে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তা আবার ৮১ শতাংশে নেমেছে।’’
রিপোর্টে আইএমএফ ভারতের বিনিময় হার ব্যবস্থা ‘স্থিতিশীল’ অবস্থায় রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে। কিন্তু মুদ্রা বিনিময় হারের নমনীয়তার গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে আইএমএফের সেই দাবির বিরোধিতা করেছে ভারত।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বার্ষিক রিপোর্টে আইএমএফ ভারতের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও দেখিয়েছে। রিপোর্ট বলেছে যে, ভারত সরকার যদি অর্থনীতিতে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন করে তা হলে বর্তমান এবং পরবর্তী অর্থবর্ষে অর্থনৈতিক উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে।
একটি বিবৃতিতে আইএমএফ এ-ও জানিয়েছে, ভারতকে তার ঋণ কমানোর জন্য মাঝেমধ্যে রাজস্ব আদায়ে ‘উচ্চাভিলাষী’ হতে হবে।
বিবৃতিতে আইএমএফ বলেছে, ‘‘আসন্ন অর্থবর্ষে বিশ্ব মন্দা বাণিজ্য ও অর্থনীতির মাধ্যমে ভারতের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে পণ্যের দামে হেরফের দেখা দিতে পারে। ফলে এই পরিস্থিতিতে ভারতের অর্থনীতিতে চাপ পড়তে পারে।’’
ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর ডি সুব্বারাও ভারতের ঋণ-জিডিপি অনুপাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি জানিয়েছেন, সরকারের উচিত ঋণের পরিমাণ কমানো। অন্যথায় তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনকি ভারতে আস্থা হারাতে পারেন অনেক বিনিয়োগকারী।
উল্লেখযোগ্য যে আইএমএফের এই রিপোর্টে গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশ্যে এলেও তার আগে থেকেই সরকারি ঋণের দিকে নজর দিয়েছে কেন্দ্র।
অক্টোবর মাসে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন জানিয়েছিলেন, কেন্দ্র সরকারি ঋণ কমানোর উপায়গুলি দেখছে এবং ঋণ কমানোর কী কী পদক্ষেপ করা যেতে পারে তা পর্যবেক্ষণ করছে।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৩ সালের মার্চের শেষে কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণ ১৫ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটি টাকা বা জিডিপির ৫৭.১ শতাংশ ছিল। একই সময়ে, রাজ্য সরকারগুলির ঋণ জিডিপির প্রায় ২৮ শতাংশ ছিল।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের মাথাপিছু আয় বেড়েছে।
যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, আয়ের অসম বণ্টন ভারতের কাছে এখনও একটি চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যাটি কোভিড আবহে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে আইএমএফ ব্যাপক সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য বৃদ্ধির মধ্যে ভারতের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কৃতিত্ব স্বীকার করেছে। এটি ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ ইঙ্গিত।