মায়ানমার থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে প্রায় প্রতি দিন পায়ে হেঁটে ভারতে ঢোকে প্রায় ৫০০ পড়ুয়া। সারা দিন ভারতে কাটিয়ে তারা আবার নিজেদের দেশে ফিরে যায়। কিন্তু কেন রোজ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করছে এই পড়ুয়ারা? কেন আটকানো হচ্ছে না এই খুদে পড়ুয়াদের?
২০১৮ সালের মে মাসে, ভারত এবং মায়ানমার সরকারের মধ্যে সাক্ষরিত ‘ফ্রি মুভমেন্ট’ চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী বাসিন্দারা কোনও ভিসা ছাড়াই আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবে।
এই চুক্তি অনুযায়ী, উভয় দেশেরই সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারীরা সীমান্ত থেকে ১৬ কিলোমিটার ভিতর পর্যন্ত অবাধে যাতায়াত করতে পারবেন।
মিজোরামের প্রশাসনিক কর্তারা জানিয়েছেন, সীমান্তের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে এমন ২৫০-রও বেশি গ্রাম রয়েছে যেখানে প্রায় তিন লক্ষ মানুষ বসবাস করেন। এই গ্রামবাসীরা প্রায়শই সীমান্ত শহর জোখাওথার-সহ ১৫০টি চেকপোস্ট দিয়ে যাতায়াত করেন।
ভারতে সীমান্ত এলাকায় দায়িত্বে থাকা পুলিশ মায়ানমার থেকে ক’জন শিশু ভারতে প্রবেশ করছে তার হিসাব রাখে। তবে চুক্তি অনুযায়ী তাদের কেউ আটকায় না।
আর এই চুক্তির লাভ ওঠাচ্ছে মায়নমারের সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী খুদে পড়ুয়ারা। বৃষ্টিভেজা জুনের সকালে বহু খুদে পড়ুয়াকেই ছাতা হাতে এবং ব্যাগ কাঁধে অভিভাবকদের সঙ্গে ভারতে প্রবেশ করতে দেখা যায়।
তিয়াউ নদীর উপরে থাকা একটি ব্রিজ, একটি সিমেন্টের তোরণ এবং একটি ইস্পাতের গেট পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে বহু পড়ুয়া। তোরণে লেখা, ‘ধন্যবাদ। আবার আসবেন’। এই ব্রিজ, তোরণ, ইস্পাতের গেট এবং তিয়াউ নদীই সীমান্ত পেরিয়ে এক দেশ থেকে অপর দেশে যাওয়া মানুষগুলির জন্য মাইলফলকের কাজ করে।
প্রতি দিন তিয়াউ নদীর ব্রিজ পেরিয়ে পড়ুয়ারা সীমান্তের গেটে পৌঁছলে মিজোরাম পুলিশের কর্মীরা তাঁদের প্রবেশের অনুমতি দেয়। পুলিশ এই গেটটি সকাল ৭টা থেকে দু’ঘণ্টা খোলা রাখে যাতে পড়ুয়ারা এই দেশে প্রবেশ করতে পারে। ব্রিজ থেকে কয়েক মিটার দূরে একটি কাস্টমস অফিস। ঘড়ির কাঁটায় ৯টা বাজলেই গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়।
প্রতি দিন কত জন ছাত্র সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করছে তার কোনও নির্দিষ্ট হিসাব নেই। কোনও কোনও দিন এই সংখ্যা ৫০০ পেরিয়ে যায়। কোনও দিন আবার ৩০০-র নীচে নেমে যায়।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের সময় সীমান্তবর্তী বেশ কিছু এলাকায় থাকা বহু স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। সীমান্ত এলাকায় থাকা মায়ানমারের খাওমাউই এ রকমই একটি এলাকা। এই এলাকা থেকে মিজোরামের চম্পাই জেলার জোখাওথার শহরের দূরত্ব খুবই কম।
কোভিড অতিমারি আবহে দু’বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে মিজোরামের স্কুলগুলি আবার চালু হয়। তবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্কুল যাওয়ার উপায় ছিল না খাওমাউইয়ের মতো একাধিক সীমান্তবর্তী এলাকায় থাকা পড়ুয়াদের। তাই শিক্ষার চাহিদা মেটাতে সীমান্ত এলাকায় থাকা প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী প্রতি দিন আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করতে ভারতে এসে পড়াশোনা করতে শুরু করে। তবে ভারতে পড়তে আসা মায়ানমারের ছাত্রদের এক ক্লাস নিচুতে ভর্তি করা হয়।
মায়ানমার থেকে আসা পড়ুয়ারা মূলত ভর্তি হয়েছে জোখাওথারের সেন্ট জোসেফ স্কুল-সহ নয়় সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে। শুধুমাত্র ভারতীয় ছাত্রদের সঙ্গেই নয়, মায়ানমার থেকে আসা অন্য শরণার্থী শিশুদের সঙ্গে একই কক্ষে বসে তাদের পড়াশোনা চলে। মায়ানমার সামরিক বাহিনীর দখলে যাওয়ার পর গত এক বছরে সেই দেশের বহু পরিবার মিজোরামে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
জোখাওথারের একটি বেসরকারি স্কুলের অধ্যক্ষের মতে, মায়ানমারের শরণার্থী শিশুদের পাশাপাশি ভারতে পাকাপাকি ভাবে আসেনি সে দেশের এমন শিশুদেরও স্কুলে ভর্তি নেওয়া হয়েছে। তারা অন্য ছাত্রদের মতো সমান বেতন দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও তিনি জানান।
তবে চম্পাইয়ের ডেপুটি কমিশনার জেমস লালরিঞ্চনার দাবি, মায়ানমারের ছাত্ররা সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে এসে স্কুল করে আবার ফিরে যায়, এমন তথ্য তাঁর কাছে নেই। আর যদি তা হয়, তা-ও একটি নির্দিষ্ট এলাকায় হচ্ছে বলেই তিনি মন্তব্য করেন।
মিজোরামের স্কুলগুলিতে সীমান্ত পেরিয়ে ছাত্র ভর্তি হওয়ায় কতটা চাপ বাড়ছে? এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেন্ট জোসেফ স্কুলের অধ্যক্ষ ফ্রান্সিস সাইলো বলেন, ‘‘কোভিড এবং সহিংসতার কারণে মায়ানমারের বহু পড়ুয়া শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা অনেক পিছিয়ে পড়েছে। তারা সীমান্ত পেরিয়ে আমাদের স্কুলে ভর্তি হওয়ায় আমরা তিনটি নতুন শ্রেণিকক্ষ তৈরি করেছি।” এই স্কুলে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ৫২৪ পড়ুয়া রয়েছে। যাদের মধ্যে ২০৬ জন মায়ানমারের।
সীমান্ত থেকে দু’কিলোমিটার দূরে একটি সরকারি প্রাক-প্রাথমিক স্কুলেও পড়ুয়াদের উপচে পড়া ভিড়। এই স্কুলের ৩০৬ জন পড়ুয়ার মধ্যে ২১৫ জন মায়নমারের। এদের মধ্যে প্রায় ২০০ জন প্রতিনিয়ত যাতায়াত করে। শিক্ষকের সংখ্যা আট। এই কারণে নতুন পড়ুয়াদের জন্য একটি নতুন প্রাক-প্রাথমিক বিভাগ তৈরি করতে হয়েছে বলে স্কুলের অধ্যক্ষ এইচ লাইরিখুমা জানিয়েছেন। তবে ইংরেজি ভাষায় বিশেষ পারদর্শী নয় মায়ানমারের এই পড়ুয়ারা। তাই তাদের অনেককে একদম গোড়া থেকে ইংরেজি শিক্ষা দিতে হচ্ছে বলেও অনেক শিক্ষকদের দাবি।
মায়ানমারের শরণার্থীদের ভারতে প্রবেশ করানো নিয়ে কেন্দ্র এবং ফেডারেল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট সরকারের মধ্যে মতের মিল ছিল না। ২০২১ সালের মার্চ মাসে কেন্দ্রের তরফে মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচল প্রদেশ, এই চার রাজ্যকে নির্দেশ দেওয়া হয় যাতে মায়নমারের সীমান্ত পেরিয়ে আসা মানুষদের প্রবেশের অনুমতি না দেয়। যাঁরা ইতিমধ্যেই ভারতে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে আবার সে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশও দেয় কেন্দ্র।
মায়ানমার থেকে আগত শরণার্থীদের যাতে মিজোরামে ঢুকতে দেওয়া হয়, সেই অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দেন মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা।
মিজোরাম সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ৪ জুন পর্যন্ত, মায়ানমার থেকে প্রায় ২৯,৯৬৪ জন শরণার্থী মিজোরামে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এদের মধ্যে ১১,৮৩৩ জন ১৪৯টি ত্রাণ শিবিরে বসবাস করেন। বাকিরা রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করছেন।
মিজোরাম সরকার এই শরণার্থীদের অস্থায়ী পরিচয়পত্রও প্রদান করেছে।