মহুয়া মৈত্রের আইফোন হ্যাক করতে চায় মোদী সরকার, অ্যাপল সংস্থা থেকে তেমনই সতর্কবার্তা এসেছে তাঁর ফোনে। কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া নিজেই এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) এই দাবি করেছেন। প্রমাণস্বরূপ অ্যাপলের মেসেজ এবং ইমেলের স্ক্রিনশট সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন তিনি।
অ্যাপল থেকে মহুয়ার আইফোনে যে সতর্কবার্তা এসেছে বলে দাবি করা হয়েছে, সেখানে লেখা রয়েছে, ‘‘রাষ্ট্র পরিচালিত হ্যাকারেরা আপনাকে ‘টার্গেট’ করেছে। অ্যাপল আইডির সঙ্গে আপনার যে আইফোনটি যুক্ত করা আছে, সেটি হ্যাক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আপনি কে, কী করেন— সম্ভবত এ সব দেখে হ্যাকারেরা নির্দিষ্ট করে আপনাকেই ‘টার্গেট’ করেছে।’
তবে অভিযোগ শুধু মহুয়াতেই থেমে থাকেনি। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ এনে মেসেজের স্ক্রিনশট সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন একাধিক বিরোধী নেতা। শিবসেনার মুখপাত্র প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদী, কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুর, আপ সাংসদ রাঘব চড্ডা, সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব, সিপিএম সাংসদ সীতারাম ইয়েচুরি এবং কংগ্রেস নেতা পবন খেরাও অ্যাপলের সতর্কবার্তা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। প্রতিবাদে সরব হয়েছেন রাহুল গান্ধীও।
যদিও বিরোধীদের আনা অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়ে বিরোধী নেতাদের আইফোনে ‘রাষ্ট্রের মদতে হ্যাকিং’য়ের সতর্কবার্তা অ্যাপল কেন পাঠিয়েছে, তা জানতে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র। সংবাদমাধ্যমের দাবি, সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘অ্যালগরিদ্মের ত্রুটি’-র কারণেই এমন বার্তা পেয়েছেন অনেকে। একে শিবসেনা সাংসদ প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদী ‘হাস্যকর অজুহাত’ বলেছেন। তাঁর প্রশ্ন, কেন বিরোধীরাই শুধু পেলেন এই বার্তা।
যদিও এই বিষয়ে অ্যাপল জানিয়েছে, কিছু বার্তা ‘মিথ্যা সঙ্কেত’ও হতে পারে। তবে এই বিষয়ে আর বেশি কিছু তথ্য দিলে তা ভবিষ্যতে সুবিধা করে দেবে ‘রাষ্ট্র পরিচালিত হামলাকারী’দেরই। মহুয়া, রাহুল-সহ বিরোধী সাংসদদের অভিযোগ নিয়ে এমনটাই জানিয়েছে অ্যাপল সংস্থা।
এর পর থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, কেমন করে কাজ করে অ্যাপল ফোনের সিকিউরিটি? অ্যাপলের ‘পাহারাদারের’ নজর এড়িয়ে কি সত্যিই তথ্য হ্যাক করে নেওয়া এতটাই সহজ? সেই প্রশ্নও উঠেছে।
অ্যাপলের তথ্য হ্যাক করা সহজ না কঠিন, তা নিয়ে তরজা তো চলছেই। তার আগে দেখে নেওয়া যাক কেমন ভাবে কাজ করে অ্যাপলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
প্রায় প্রতি মাসেই নতুন নতুন অ্যান্ড্রয়েড ফোন বাজারে আসে। কিন্তু আইফোনের ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে আইফোনের নতুন ‘ভার্সন’ বাজারে আসে। সফ্টঅয়্যার এবং ফোনের বাকি দিকগুলি নিয়ে বহু পরীক্ষানিরীক্ষা চলে। অন্তত তেমনটাই দাবি তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের।
অনেকের মতে, বাজারে যত ফোন রয়েছে, তার মধ্যে সব থেকে ‘নিরাপদ’ নাকি আইফোনই। অ্যান্ড্রয়েডের তুলনায় আইফোন তথ্য বেশি সুরক্ষিত রাখে বলে দাবি করেন তাঁরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আইফোনের হার্ডঅয়্যারের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখে অ্যাপল। শুধুমাত্র কয়েকটি নির্দিষ্ট সংস্থার কাছে হার্ডঅয়্যার তৈরির অনুমোদন রয়েছে। তবে এখন অ্যাপল ধীরে ধীরে নিজেরাই হার্ডঅয়্যার তৈরি করতে শুরু করেছে। ফলে বাইরে থেকে ফোনে তথ্য সংক্রান্ত কোনও কারচুপি করার আশঙ্কা খুব কম।
আইফোনের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম, আইওএস রয়েছে। এই অপারেটিং সিস্টেমকে এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, যা আগেভাগেই বিপদ বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। মূলত অ্যাপলকে সফ্টঅয়্যারজনিত সমস্যার হাত থেকে রক্ষা করতে এই অপারেটিং সিস্টেমটিকে তৈরি করা হয়েছে।
আইফোনের পাশাপাশি অ্যাপলের ম্যাকবুক এবং আইপ্যাডের অপারেটিং সিস্টেমও এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, যা তথ্য চুরি বা সাইবার হানার মতো পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রতিক্রিয়া করে। একে বলা হয় ‘র্যাপিড সিকিউরিটি রেসপন্স।’
একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা সংস্থার সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সারা বিশ্বের ৪৯ শতাংশ অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারী নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তার কারণে অ্যাপলের আইফোন কেনার দিকে ঝুঁকছেন।
সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, অ্যাপল ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রায় ৭৬ শতাংশই আইওএস ব্যবস্থায় বেশি সুরক্ষিত বোধ করেন। অন্য দিকে প্রায় ৭৪ শতাংশ অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীর ধারণা রয়েছে যে আইওএস প্রযুক্তি বেশি নিরাপদ। নতুন মুক্ত অপারেটিং সিস্টেমগুলি উন্নত সুরক্ষা বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে এসেছে।
সমীক্ষাটিতে দেখা যাচ্ছে যে, ৩৩ শতাংশ অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারী পরের মাসে আইওএস ১৬ চালু হওয়ার কারণে আইফোন কেনার কথা ভাবছেন। এই আইওএস-এ আসা শীর্ষ নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হল লকডাউন মোড। যা ব্যবহারকারীদের সাইবার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
লকডাউন মোড ব্রাউজ়িংকেও সীমাবদ্ধ করে। ভারতেও আইফোনের জনপ্রিয়তা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে।
পাসওয়ার্ডের বদলে ‘পাস কি’ এনে আইফোনকে আরও সুরক্ষিত করার দাবি করেছে অ্যাপল। আইওএস-১৬ থেকে এই নতুন সিস্টেম আপডেট করা হয়েছে। অ্যাপলের ওয়েবসাইট বা অ্যাপের মাধ্যমে ‘পাস কি’ সেট আপ করা যায়। এই ‘পাস কি’ হ্যাকারদের তথ্য চুরি করা কঠিন করে দিয়েছে।
তথ্যের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও অ্যাপলের আইম্যাসেজ, ফেসটাইম এবং আইক্লাউডে তথ্যের আদানপ্রদান তুলনামূলক ভাবে বেশি নিরাপদ বলে মনে করা হয়। কিন্তু অ্যান্ড্রয়েডের এই ধরনের নিজস্ব কোনও পরিষেবা নেই।
ম্যালঅয়্যারের আক্রমণের ক্ষেত্রে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের তুলনায় দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে পারে আইওএস। আইওএস নিজে থেকেই এই ধরনের অযাচিত আক্রমণে সতর্ক থাকে।
আইওএসের অ্যাপ মার্কেটপ্লেসের নিরাপত্তাও বাকি অপারেটিং সিস্টেমযুক্ত ফোনের তুলনায় আইফোনকে এগিয়ে রাখে। অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরের অ্যাপগুলির খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে তবে তা গ্রাহকদের জন্য উপলব্ধ করা হয়। এই কারণে অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে অ্যাপের সংখ্যা কম। ফলে সেখানে ক্ষতিকর অ্যাপ থাকার আশঙ্কাও খুব কম।
তবে অ্যাপলের আইওএস-এর নিরাপত্তা একেবারে নিশ্ছিদ্র নয়। তথ্য চুরির মতলবে ফাঁদ পেতে রাখা ওয়াইফাই এবং মেল বা মেসেজে আসা কোনও লিঙ্কের সাহায্যে আইফোনও হ্যাক করে নেওয়া সম্ভব।
বেশ কয়েকটি অ্যাপ এবং অন্য মানুষের সঙ্গে ফোনের তথ্য ভাগ করার সময়ও আইফোনের নিরাপত্তা লঙ্ঘন হতে পারে। চুরি হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
কিন্তু কী করে বোঝা যাবে যে আইফোন হ্যাক হয়েছে কি না? ফোন দ্রুত গরম হয়ে যাওয়া বা ব্যাটারি কম থাকা আইফোন হ্যাক হয়ে যাওয়ার লক্ষণ। পাশাপাশি সে ক্ষেত্রে যে কোনও ওয়েবসাইটে ঢুকতে তুলনামূলক ভাবে বেশি সময় লাগবে।
ফোন থেকে যদি কনট্যাক্ট লিস্টে থাকা পরিচিতদের কাছে আপনার অজান্তেই মেসেজ চলে যায়, তা হলেও ধরে নিতে হবে যে ফোন হ্যাক হয়েছে।