এলেবেলে বাজার হলে চলবে না। বাজার হতে হবে ব্রিটিশ-রুচির সঙ্গে ষোলো আনা মানানসই। সেই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় ঝাঁ চকচকে নতুন এক বাজার। দেড় শতাধিক বছর পার করেও যার ‘নতুন’ পরিচয় ঘুচলো না। অত্যাধুনিক মাল্টিপ্লেক্সের যুগে স্বমহিমায় উজ্জ্বল স্টুয়ার্ট হগসাহেবের চিরনতুন ‘নিউ মার্কেট’।
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ বলছে, সেই সময় কলকাতায় সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে পরিচিত ছিল তিরেত্তা সাহেবের বাজার বা আজকের টেরিটি বাজার এবং ধর্মতলা বাজার। চৌরঙ্গি এবং ধর্মতলা স্ট্রিটের সংযোগস্থলে ধর্মতলা বাজারের মালিক ছিলেন সে কালের অন্যতম ধনী বাঙালি, হীরালাল শীল।
কিন্তু এই বাজারের পরিবেশ পছন্দ ছিল না ব্রিটিশদের। তাঁদের মনে হয়েছিল এই বাজারের পরিবেশ বদ্ধ ও ঘিঞ্জি। জিনিসপত্রের চড়া দাম নিয়েও অভিযোগ উঠত। ফলে প্রস্তাব উঠল নতুন বাজারের। কলকাতার বাজার নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে ১৮৭১ সালে পাশ হল ‘দ্য ক্যালকাটা মার্কেটস অ্যাক্ট-৮।’
নতুন বাজার তৈরির সময় চেষ্টা করা হল ৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে পুরনো ধর্মতলা বাজারকে কিনে নেওয়ার। কিন্তু এই পদক্ষেপে সাফল্য এল না। কর্পোরেশন স্ট্রিট আর লিন্ডসে স্ট্রিটের মাঝে জায়গা স্থির করা হল নতুন বাজার তৈরির জন্য।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্থপতিকে দায়িত্ব দেওয় হল ভবনের নকশার জন্য। শেষ অবধি কাজ শুরু হল ১৮৭১-এর সেপ্টেম্বরে। ঠিকাদার বার্ন অ্যান্ড কোং-কে দেওয়া হয়েছিল ২ লক্ষ ৫৮ হাজার ৭২০ টাকা।
সে যুগে দাঁড়িয়ে এই নতুন বাজার বানাতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৬ লক্ষ টাকার বেশি। বাজার তৈরির পরে নানা জটিলতা পেরিয়ে অবশেষে ৭ লক্ষ টাকায় হাতবদল হল পুরনো ধর্মতলা বাজারও।
তিন বছর ধরে বানানোর পরে অবশেষে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি ইউরোপীয় জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হল নতুন বাজারের দরজা। কিন্তু বাজার তো হল। এর নাম কী রাখা হবে? কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান স্টুয়ার্ট হগের নামে বাজারের নামকরণ করা হল, ‘স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট’। কারণ নতুন বাজার তৈরির পিছনে তাঁর উদ্যোগ ছিল সবথেকে বেশি।
তখন অবশ্য মুখে মুখে এই বাজারকে বলা হত ‘হগসাহেবের বাজার’। ২৮ বছর পরে ১৯০৩ সালে খাতায়কলমে সরকারি ভাবে এর নাম হল ‘স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট’। তবে কলকাতাবাসীর কাছে এর আদি অকৃত্রিম পরিচয় ‘নিউ মার্কেট’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবধি বিভিন্ন সময়ে আকারে ও আয়তনে বৃদ্ধি পেয়েছে নিউ মার্কেট। ১৯০৯ সালে ৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৈরি হয়েছিল এর উত্তরের অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও জারি ছিল এর নির্মাণপর্ব।
তিরিশের দশকে বর্ধিত হয়েছিল নিউ মার্কেটের দক্ষিণ অংশ। যুক্ত হয়েছিল বিখ্যাত ক্লক টাওয়ার।
ব্রিটিশ স্থাপত্যের পাশাপাশি যা নজর কাড়ে, তা হল, নিউ মার্কেটের পসরা। বলা হয়, আলপিন থেকে হাতি, সবই নাকি পাওয়া যায় হগসাহেবের বাজারে। এখন কথার কথা হলেও সত্তরের দশক অবধি সত্যিই পোষ্য পাওয়া যেত এই বাজারে।
আনাজপাতি, মাছ-মাংস, ফল, নানা ধরনের ফুল থেকে শুরু করে জামাকাপড়, জুতো, ব্যাগ, প্রসাধনী, এমনকি, বিভিন্ন রকমের পরচুলা, সবই থরে থরে সাজানো নিউ মার্কেটের চার হাজার পসরায়। পাশাপাশি পাওয়া যায় বৈদ্যুতিন সামগ্রী, বাসনপত্র এবং হালফ্যাশনের ব্যাগ।
শপিং মল-পূর্ববর্তী কলকাতায় বিদেশি তথা ব্র্যান্ডেড জিনিসের একমাত্র ঠিকানা ছিল নিউ মার্কেট। এখনও হগ সাহেবের এই বাজারের নাহুমস-এর দোকানের কেক, পেস্ট্রি-সহ অন্য খাবারকে সেরা বলে থাকেন খাদ্যরসিকরা। নানারকমের চিজের জন্যও নিউ মার্কেট ক্রেতাদের কাছে সেরা গন্তব্য।
হালফিলের শপিং মল-এর রমরমার মধ্যেও নিউ মার্কেট আছে নিজের ‘অন্যরকম ঘরনার’ জায়গাতেই। ১৯৮৫-র ১৩ ডিসেম্বর, ২০১১-র ২০ জুলাই এবং ২০১৫-র ১৮ মে, এই তিনদিন অগ্নিকাণ্ডে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিউ মার্কেট। কিন্তু আগুনও কেড়ে নিতে পারেনি তার গরিমা। হগসাহেবের নতুন বাজার এখনও কলকাতাবাসীর কাছে চিরবসন্তের দূত। (ঋণস্বীকার: মিউনিসিপ্যাল ক্যালকাটা:ইটস ইনস্টিটিউশন ইন দেয়ার অরিজিন অ্যান্ড গ্রোথ, এস ডব্লু গুড, কলিকাতার রাজপথ সমাজে ও সংস্কৃতিতে, অজিতকুমার বসু (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)(ছবি:সোশ্যাল মিডিয়া)