ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারত মহাসাগরের উপরে অবস্থিত ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মলদ্বীপ। ভারতের সঙ্গে বরাবরই তার সুসম্পর্ক। মলদ্বীপকে অর্থ, সেনার সুরক্ষা দিয়ে বার বার সাহায্য করেছে ভারত।
সেই পরম বন্ধুত্ব থেকে আচমকা মলদ্বীপের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে তাদের তিন মন্ত্রীর অবমাননাকর মন্তব্যে শোরগোল পড়ে গিয়েছে দুই দেশে। ভারতে উঠেছে ‘বয়কট মলদ্বীপ’ স্লোগান।
ইতিহাস ঘাঁটলে এই মলদ্বীপের সঙ্গেই ভারতের সুসম্পর্কের একাধিক নজির খুঁজে পাওয়া যায়। একাধিক কঠিন পরিস্থিতিতে মলদ্বীপের পাশে দাঁড়িয়েছে ভারত। তেমনই এক অভিযানের নাম ‘অপারেশন ক্যাকটাস’।
‘অপারেশন ক্যাকটাস’ মলদ্বীপে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযান। যার মাধ্যমে একেবারে খাদের কিনারা থেকে পড়শি দেশটিকে তুলে এনেছিল ভারত।
ভারতীয় সেনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অভিযানে সাফল্য পেয়েছে। তবে খুব কম ক্ষেত্রেই অভিযানে সেনার তিন বাহিনীকে একসঙ্গে মাঠে নামতে দেখা গিয়েছে। মলদ্বীপের ‘অপারেশন ক্যাকটাস’ ছিল তেমনই এক বিরল অভিযান।
১৯৮৮ সালের ৩ নভেম্বর। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের কাছে মলদ্বীপ থেকে সাহায্য চেয়ে জরুরি বার্তা এসে পৌঁছয়। শ্রীলঙ্কান জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন আবদুল্লা লুথুফি।
লুথুফি ছিলেন মলদ্বীপের জনপ্রিয় শিল্পপতি। তিনি শক্তি সঞ্চয় করে শ্রীলঙ্কান জঙ্গিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশে সরকার ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁদের ভয়ে মলদ্বীপের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মৌমুন আব্দুল গায়ুমকে গা ঢাকা দিতে হয়েছিল নিজের দেশেই।
মলদ্বীপে সামরিক অভ্যুত্থানের খবর পেয়ে নড়েচড়ে বসে ভারত। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষীদের (ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড) সঙ্গে হাত মেলায় ভারতীয় সেনা। মলদ্বীপের পাশে দাঁড়াতে সে সময় দু’বার ভাবেনি ভারত।
সাহায্যের জন্য মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ভারত ছাড়াও আর্জি জানিয়েছিলেন পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা এবং ব্রিটেনের কাছে। সেনা দিয়ে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোনও বন্ধু দেশই ফিরে তাকায়নি।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মলদ্বীপকে সাহায্যের আশ্বাস দেন। দ্রুত তৈরি হয় রণসজ্জা। ভারতের স্থলবাহিনী, নৌসেনা এবং বায়ুসেনা মলদ্বীপে অভিযান চালায়।
মলদ্বীপে গায়ুমের সরকার এর আগে আরও দু’বার সামরিক অভ্যুত্থানের মুখে পড়েছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতা যার অন্যতম কারণ। ১৯৮৮ সালের অভ্যুত্থান ছিল সবচেয়ে বড় এবং বিপজ্জনক।
শ্রীলঙ্কার জঙ্গি গোষ্ঠী পিপ্লস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অফ তামিল এলাম (পিএলওটিই)-এর বহু সদস্য শ্রীলঙ্কা থেকে একটি বিমান ছিনতাই করে মলদ্বীপে পৌঁছেছিলেন। দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলি একের পর এক তাঁরা দখল করে নেন। বিমানবন্দর, সরকারি ভবন সব জঙ্গিদের দখলে চলে গিয়েছিল চোখের নিমেষে।
মলদ্বীপে ভারতীয় সেনা পৌঁছয় ৩ নভেম্বর রাতে। সাহায্য চেয়ে ফোন আসার মাত্র ৯ ঘণ্টার মধ্যেই মলদ্বীপে ভারত সেনা পাঠিয়ে দিয়েছিল। ভারত যে মলদ্বীপকে সাহায্য করবে, এত দ্রুত যে ভারতীয় সেনা সেখানে পৌঁছে যাবে, বিদ্রোহীরা তা আন্দাজ করতে পারেননি। ফলে দ্রুত তারা পিছু হটে।
একটি মালবাহী জাহাজে ২৭ জন পণবন্দিকে নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা করেছিল শ্রীলঙ্কার জঙ্গিরা। পণবন্দিদের মধ্যে ছিলেন মলদ্বীপের পরিবহণমন্ত্রী আহমেদ মুজুতুবা এবং তাঁর স্ত্রী।
পণবন্দিদের নিয়ে জঙ্গিদের জাহাজ শ্রীলঙ্কার দিয়ে রওনা দিয়েছিল। পিছনে ধাওয়া করেছিল ভারতীয় নৌসেনার জাহাজ। মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করা হচ্ছিল। পালাবার পথ পাচ্ছিল না জঙ্গিরা।
বাঁচার জন্য শেষ মুহূর্তে মরিয়া চেষ্টা করে জঙ্গিরা। জাহাজের দুই পণবন্দির মাথা কেটে তারা সমুদ্রে ফেলে দেয়। তা দেখে ভারতীয় বাহিনী ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু নৌসেনা থামেনি।
শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার জঙ্গি এবং মলদ্বীপের বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করতে হয় ভারতের কাছে। জঙ্গিদের বন্দি করে জাহাজে মলদ্বীপে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মাত্র ১৬ ঘণ্টায় শেষ হয় মলদ্বীপের সামরিক অভ্যুত্থান।
ভারতীয় সেনা জওয়ানেরা পরে জানিয়েছিলেন, সে সময়ে মলদ্বীপের সাধারণ মানুষের চোখেমুখে যে কৃতজ্ঞতার ছাপ তাঁরা দেখেছিলেন, তা বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পর আর দেখা যায়নি।
মলদ্বীপের বিপদে এ ভাবেই বার বার পাশে দাঁড়িয়েছে ভারত। কিন্তু সম্প্রতি সেখানে কুর্সিতে বসেছেন চিনপন্থী শাসক মহম্মদ মুইজ্জু। নির্বাচনের আগেও তিনি ভারত-বিরোধী প্রচার চালিয়েছিলেন দেশে।
ক্ষমতায় এসেই মুইজ্জু মলদ্বীপের মাটি থেকে ভারতীয় সেনাকে সরে যেতে বলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর লক্ষদ্বীপ সফর নিয়ে তাঁর মন্ত্রীদের উপহাস একেবারেই ভাল চোখে দেখছে না নয়াদিল্লি। যা দুই দেশের সম্পর্কের অবনতির পরিচায়ক।