ভারত-মলদ্বীপ নিয়ে বিতর্কের মাঝে দেশবাসীর চোখ এখন লক্ষদ্বীপের দিকে। ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা চলছে ভারতীয় কেন্দ্রশাসিত দ্বীপপুঞ্জকে ঢেলে সাজানোর।
লক্ষদ্বীপকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনায় হাত বাড়িয়েছে ভারতের একাধিক বেসরকারি সংস্থা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য টাটা গোষ্ঠী।
পাশাপাশি, যে দেশের ‘ক্রীড়নক’ বলে মলদ্বীপের নিলম্বিত এক মন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কটাক্ষ করেছিলেন, সেই ইজ়রায়েলও লক্ষদ্বীপের উন্নতি সাধনে আসরে নেমেছে।
লক্ষদ্বীপে পানীয় জলের সমস্যা রয়েছে। একই সমস্যায় ভুগতে হত ইজ়রায়েলকেও। কিন্তু ইজ়রায়েল উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছে। ওই প্রযুক্তির সাহায্যে মূলত সমুদ্রের নোনা জল পানযোগ্য করা হয়।
ইজ়রায়েলের সেই উন্নত জল পরিশোধন প্রযুক্তিই এ বার কাজে লাগতে চলেছে লক্ষদ্বীপে। মঙ্গলবার থেকে ইতিমধ্যেই প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে।
সোমবার সমাজমাধ্যম ‘এক্স (সাবেক টুইটার)’ হ্যান্ডলের একটি পোস্টে ইজ়রায়েলি দূতাবাস লিখেছে, ‘‘ভারত সরকারের অনুরোধে জল পরিশোধন প্রকল্প শুরু করার জন্য আমরা গত বছর লক্ষদ্বীপে গিয়েছিলাম। ইজ়রায়েল মঙ্গলবার থেকে এই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে প্রস্তুত।’’
মলদ্বীপের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপড়েনের আবহে আরব সাগরের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লক্ষদ্বীপে নয়া বিমানবন্দরও চালু হতে চলেছে।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে লক্ষদ্বীপের মিনিকয়ের ওই নয়া বিমানবন্দরে থাকছে ভারতীয় বায়ুসেনার যুদ্ধবিমান ওঠানামার উপযোগী রানওয়ে। সরকারি সূত্রের খবর, ভবিষ্যতে সামরিক এবং অসামরিক দু’ধরনের প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবনায় রেখেই তৈরি হচ্ছে নয়া বিমানবন্দর।
মিনিকয় দ্বীপে বায়ুসেনার একটি ঘাঁটি আগেই ছিল। তবে সেখানে শুধুমাত্র যুদ্ধবিমানই ওঠানামা করে। এ বার স্বয়ংসম্পূর্ণ বিমানবন্দর হলে অসামরিক বিমান ওঠানামা করার ক্ষেত্রে সুবিধাই হবে।
সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, সামরিক, অসামরিক এবং পণ্য পরিবহণের জন্য বিমান ওঠানামা করবে মিনিকয়ের সেই বন্দর থেকে।
বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের নজরদারি করতে অনেকটা সুবিধা হবে। দেশের পর্যটকদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যটকদেরও নজরে আসবে লক্ষদ্বীপ।
লক্ষদ্বীপের সমুদ্রে প্রধানমন্ত্রী মোদীর স্নর্কেলিং (এক ধরনের জলক্রীড়া) করা, সাদা বালির উপর ভ্রমণ বা বিশাল নীল সৈকতে বিশ্রাম নেওয়ার ছবি প্রকাশ্যে আসার দিনই ৫০ হাজার মানুষ লক্ষদ্বীপ নিয়ে গুগ্লে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। ফলে মনে করা হচ্ছে চলতি বছর থেকেই ভিড় বাড়তে শুরু করবে লক্ষদ্বীপের সমুদ্রসৈকতে।
লক্ষদ্বীপের জনপ্রিয়তা যে ভাবে গত কয়েক দিনে বেড়েছে, সে দিকে নজর দিয়ে, টাটা গোষ্ঠী ২০২৬ সালের মধ্যে সুহেলি এবং কদমত দ্বীপে দু’টি বিলাসবহুল হোটেল খোলার পরিকল্পনা করছে।
লক্ষদ্বীপের জনপ্রিয় দু’টি দ্বীপ সুহেলি এবং কদমত। পর্যটকের ভিড় এই দুই জায়গাতেই মূলত বেশি। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের পাশাপাশি দেশীয় পর্যটকদের জন্যও এটি একটি বড় পাওনা হবে।
মলদ্বীপের হোটেলগুলিতে যা যা সুবিধা থাকে, টাটার ওই বিলাসবহুল হোটেলগুলিতেও একই সুবিধা থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
একই সঙ্গে মলদ্বীপের জনপ্রিয় ‘ওয়াটার রিসর্ট’-এর আদলে লক্ষদ্বীপের সমুদ্রসৈকতেও ছোট ছোট কামরা নিয়ে রিসর্ট তৈরির পরিকল্পনাও জোরকদমে চলছে বলে জানা গিয়েছে।
২০২২ সালে লক্ষদ্বীপ বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা ছিল মাত্র এক লক্ষ। ২০২১ সালের থেকে মাত্র চার হাজার বেশি। তবে লক্ষদ্বীপে এখন দেশের পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
ঝিকিমিকি লেগুন, সাদা বালির সৈকত এবং প্রচুর প্রবাল— লক্ষদ্বীপ এবং মলদ্বীপের মধ্যে মিল প্রচুর। কিন্তু তবুও বিলাসবহুল ভ্রমণের উদ্দেশে ভারতীয়দের বেশি ভিড় জমে মলদ্বীপে। ২০২১ এবং ২০২২ সালে প্রায় আড়াই-তিন লক্ষ ভারতীয় মলদ্বীপ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেই রীতিই পাল্টাতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। মলদ্বীপের বিকল্প হয়ে দাঁড়াতে চলেছে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লক্ষদ্বীপ।
ভারতের ক্ষুদ্রতম কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লক্ষদ্বীপ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে অবমাননাকর মন্তব্য করায় বিগত কয়েক দিনে যে ঝড় বয়ে গিয়েছে, তার জেরেই রোষের মুখে পড়েছে মলদ্বীপ সরকার। এর পরেই সমাজমাধ্যম জুড়ে ‘বয়কট মলদ্বীপ’-এর হিড়িক উঠেছে। মলদ্বীপকে বয়কট করার ডাক দিয়েছেন বলিউড ও ক্রিকেট মহলের নক্ষত্রেরাও। পাশাপাশি তাঁরা উৎসাহ জোগাচ্ছেন লক্ষদ্বীপ ঘুরে দেখার।
সমাজমাধ্যমে ‘বয়কট মলদ্বীপ’-এর ঠেলা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারত মহাসাগরের উপরে অবস্থিত ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র। আগে থেকেই মলদ্বীপে ঘুরতে যাওয়ার বিমান-হোটেলে টিকিট বুক করে রাখার পরেও তা বাতিল করে চলেছেন একের পর এক ভারতীয় পর্যটক। ক্রমে সেই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যাঁরা বুকিং বাতিল করছেন, তাঁদের দাবি, টাকা যাচ্ছে যাক। আগে দেশ। দেশের অপমান কোনও ভাবে মেনে নেওয়া যাবে না বলেও কেউ কেউ সমাজমাধ্যমে মতপ্রকাশ করেছেন।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মলদ্বীপের তিন মন্ত্রী (বর্তমানে নিলম্বিত) ভারত এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করার পর থেকে কমপক্ষে ১৪ হাজার হোটেল এবং প্রায় চার হাজার বিমানের টিকিট বাতিল করেছেন ভারতীয়েরা। যা, মলদ্বীপের পর্যটন এবং অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
ভারতের এক জনপ্রিয় ভ্রমণ সংস্থাও মলদ্বীপ যাওয়ার সমস্ত বিমানের টিকিট বুকিং বাতিল করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। ওই সংস্থার মালিক জানিয়েছেন, দেশের প্রতি আনুগত্য এবং সহানুভূতি থেকে তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রবিবার রাতে ওই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা নিশান্ত পিট্টি এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে লেখেন, ‘‘দেশের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা মলদ্বীপের সমস্ত বিমানের টিকিটের বুকিং বাতিল করে দিয়েছি।’’ অর্থাৎ, যাঁরা ওই সংস্থার মাধ্যমে মলদ্বীপে যাওয়ার বিমানের টিকিট কেটেছিলেন, তাঁদের টিকিট বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
মলদ্বীপের নাগরিকদের একাংশও ভারত এবং মোদীকে নিয়ে মন্তব্যের কারণে নিজের দেশের সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ওই তিন মন্ত্রীর মন্তব্যের সমালোচনা করে সরব হয়েছেন সরকার পক্ষের অনেকেও।
দেশের পর্যটন ব্যবসাকে বিপদের মুখে পড়তে দেখে তড়িঘড়ি ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করতে নেমে পড়েছে মলদ্বীপ সরকার। ভারতীয়রা মলদ্বীপে ঢুঁ মারা বন্ধ করে দিলে দেশের অর্থনীতি বিপদের মুখে পড়তে পারে ভেবে ভুল শোধরানোর চেষ্টা শুরু করেছে মলদ্বীপের সরকার। কারণ মলদ্বীপের অর্থনীতি অনেকটাই পর্যটন নির্ভর। সারা বছর ভারতীয় পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারত মহাসাগরের উপরে অবস্থিত ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রে।
তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও মন কষাকষি হয়েছে ভারত-মলদ্বীপের। তবে ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী মলদ্বীপের সম্পর্কে চিড় ধরতে দেখা গিয়েছে সে দেশের শাসকের গদিতে মহম্মদ মুইজ়ু আসার পর। কূটনৈতিক সম্পর্কেও বেশ কিছুটা ফাটল ধরেছে।
মুইজ়ু ‘চিনপন্থী’ হিসাবে পরিচিত। মলদ্বীপের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ সোলি ভারতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার যে নীতি নিয়ে চলতেন, সেই ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতি থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েই ভোটের ময়দানে নেমেছিলেন তিনি। জিতেও যান। তার পর থেকেই তিনি ভারতকে চাপে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা। প্রথমে মলদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনাদের সরিয়ে দেওয়ার সরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ ভারতের কাছে করেন মইজ়ু। পরে ভারতের সঙ্গে একটি জলচুক্তি বাতিলের পথেও হাঁটেন।
তবে সব থেকে সমস্যা দেখা দিয়েছে সাম্প্রতিক বিতর্কে। ভারত এবং প্রধানমন্ত্রী মোদীর সম্পর্কে মলদ্বীপ সরকারের তিন প্রতিনিধির কুমন্তব্যের জেরে তোলপাড় হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি।