পাঁচ দিনের তল্লাশি অভিযানের পর অতলান্তিক মহাসাগরে খোঁজ মিলেছে হারিয়ে যাওয়া ডুবোযান টাইটানের। তার মধ্যে যে পাঁচ জন ছিলেন, তাঁরা কেউই বেঁচে নেই, ঘোষণা করেছে আমেরিকার উপকূলরক্ষী বাহিনী।
অতলান্তিকের গভীরে ১১১ বছর আগে ডুবে যাওয়া জাহাজ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে অভিযাত্রীদের নিয়ে ডুব দিয়েছিল টাইটান। সেই জলেই টাইটানিকের মতো মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছে সেটির।
টাইটানে ছিলেন ব্রিটেনের কোটিপতি ব্যবসায়ী হামিশ হার্ডিং, পাকিস্তানের ব্যবসায়ী শাহজ়াদা দাউদ এবং তাঁর পুত্র সুলেমান, ওশানগেট সংস্থার মুখ্য আধিকারিক স্টকটন রাশ এবং ফরাসি নাবিক পল হেনরি নারজিওলেট।
কানাডার পূর্বে নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের উপকূল থেকে অতলান্তিকে ডুব দিয়েছিল টাইটান। যাত্রা শুরুর ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে ওশানগেট সংস্থার তৈরি ওই ডুবোযানের সঙ্গে সহকারী জাহাজের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
উপকূলরক্ষী বাহিনী থেকে শুরু করে ডুবোযান তৈরির সংস্থা, সব পক্ষই নিশ্চিত করে জানিয়েছে, টাইটানে থাকা কোনও যাত্রীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। রোবটের মাধ্যমে টাইটানের ধ্বংসাবশেষের খোঁজ মিলেছে।
টাইটানের ধ্বংসাবশেষ মিলেছে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ থেকে ১৬০০ ফুট দূরে। তবে ধ্বংসাবশেষ কোথায় আছে জানা গেলেও তার কাছাকাছি পৌঁছনো যায়নি। দুর্ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি অত্যন্ত প্রতিকূল বলে জানিয়েছে উপকূলরক্ষী বাহিনী।
আমেরিকার উপকূলরক্ষী বাহিনীর তরফে দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে আকস্মিক ‘ইমপ্লোশন’-এর কথা বলা হয়েছে। এর ফলেই গভীর সমুদ্রে বিপদে পড়েছিল টাইটান।
‘ইমপ্লোশন’ হল বিস্ফোরণের (এক্সপ্লোশন) বিপরীত অবস্থা। এর ফলে কোনও বস্তু আচমকা ফেটে না গিয়ে ভিতরের দিকে চুপসে যায়। এ ভাবে কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে ধ্বংস হয়েছে টাইটান।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, টাইটানিকের দিকে টাইটান যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন সমুদ্রের একটি নির্দিষ্ট অংশে পৌঁছে জলের প্রচণ্ড চাপ পড়ে ডুবোযানের উপর। তার ভিতরে থাকা বায়ুর চাপের চেয়েও বাইরের জলের চাপ ছিল বেশি।
এই সময় জলের চাপে আচমকা ভিতরের দিকে চুপসে যায় টাইটান। ডুবোযানের ধাতব দেওয়াল দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ফলে ভিতরেই দেওয়ালের চাপে পিষ্ট হয়ে যান যাত্রীরা।
মনে করা হচ্ছে, টাইটানের যাত্রীরা বেশি সময় পাননি। মৃত্যু ছিল তাৎক্ষণিক এবং আকস্মিক। কী হচ্ছে, বুঝে ওঠার আগেই ডুবোযানটি চুপসে যায়। পিষে মৃত্যু হয় ভিতরের সকলের।
কিন্তু কেন আচমকা এই ‘ইমপ্লোশন’? তার স্পষ্ট কারণ জানা যায়নি। ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যাপক রডেরিক স্মিথ জানিয়েছেন, টাইটানের ধাতব কাঠামো ত্রুটিপূর্ণ ছিল। সেটি জলের চাপ সহ্য করতে পারেনি।
তবে কেন ডুবোযানের এই পরিণতি, তা নিশ্চিত ভাবে জানতে টাইটানের ধ্বংসাবশেষ সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা প্রয়োজন। তার পরেই এ বিষয়ে খুঁটিনাটি তদন্ত সম্ভব, বলছেন বিশেষজ্ঞেরা।
টাইটানের দৈর্ঘ্য ছিল ২২ ফুট। ওজন ৯,৫২৫ কেজি। কার্বন ফাইবার এবং টাইটানিয়াম দিয়ে তৈরি এই ডুবোযানের পাঁচ জনের বেশি বহন ক্ষমতা ছিল না।
সমুদ্রের ১৩,১২০ ফুট গভীর পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা ছিল টাইটানের, তেমনটাই দাবি অভিযানের আয়োজক সংস্থা ওশানগেটের। আর বিলাসবহুল জাহাজ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে অতলান্তিকের সাড়ে ১২ হাজার ফুট গভীরে।
টাইটান ছিল ৯ ফুট চওড়া। এই ডুবোযানে সওয়ারিদের জন্য জায়গা ছিল খুবই অল্প। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর বা হাঁটু মুড়ে বসার মতো জায়গাও ছিল না টাইটানের ভিতরে।
টাইটানের মধ্যে সওয়ারিদের একে অপরের গা ঘেঁষে বসতে হয়েছিল। ডুবোযানের ধাতব মেঝেতে পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা ছিল না। এমনকি, যাত্রীরা পা-ও ছড়াতে পারেননি। তবে টাইটানে ছিল একটি শৌচাগার।
কোনও জানলা ছিল না টাইটানে। ছিল কেবল একটি ‘পোর্টহোল’। তা দিয়েই সমুদ্রের তলার দৃশ্য এবং টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ চাক্ষুষ করার সুযোগ মেলে সওয়ারিদের।
টাইটানের উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছিল আমেরিকা, কানাডা। এ ছাড়া, ওশানগেটের মাধ্যমেও আলাদা করে উদ্ধারকাজ চালানো হয়েছিল। কিন্তু ধ্বংসাবশেষের খোঁজ পাওয়ার পর তদন্ত নিয়ে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে।
কারা টাইটানের ধ্বংসের তদন্ত করবে, সে বিষয়ে একাধিক নাম উঠে এসেছে। আমেরিকা বা কানাডার উপকূলরক্ষী বাহিনী ছাড়াও টাইটান তদন্ত চালাতে পারে অন্য ফেডেরাল এবং আন্তর্জাতিক এজেন্সিগুলি।