জীবনের দূত হওয়ার কথা তাঁর। কিন্তু আদতে তিনি ছিলেন ‘মৃত্যুর দূত’। চিকিৎসক হয়েও দুই শতাধিক রোগীকে খুন করেছিলেন তিনি। সংখ্যাটা কেউ কেউ দাবি করেন আড়াইশো। সে কারণে হ্যারল্ড শিপম্যানকে ইতিহাস চেনে ‘ডক্টর ডেথ’ বলে।
২০০০ সালে নিজের ১৫ জন রোগীকে খুনের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন হ্যারল্ড। তাঁকে যাবজ্জীবন দেয় আদালত। যদিও মনে করা হয়, অন্তত ২৫০ জন রোগীকে খুন করেছিলেন তিনি। নিহতদের বেশির ভাগই প্রবীণ মহিলা।
কে এই হ্যারল্ড শিপম্যান? ১৯৪৬ সালে ইংল্যান্ডের নটিংহ্যামে জন্ম তাঁর। লিডস স্কুল অফ মেডিসিনে চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৭৬ সালে টডমরডেনের একটি হাসপাতালে কাজ শুরু করেন।
রোগীরা চাইলে তাঁদের নিষিদ্ধ পেনকিলার ওষুধ লিখে জাল প্রেসক্রিপশন দিতেন। নিজেও সেই পেনকিলার খেয়ে নেশা করতেন। ডাক্তারি শুরু করার এক বছরের মাথায় ৬০০ পাউন্ড জরিমানা হয় হ্যারল্ডের। ভারতীয় মুদ্রায় এখন মূল্য ৫৫ হাজার ২৫৫ টাকা। জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল তাঁকে প্র্যাকটিস করতে নিষেধ করে দেয়।
তিন বছর পর গ্রেটার ম্যাঞ্চেস্টরে গিয়ে ফের প্র্যাকটিস শুরু করেন হ্যারল্ড। কোনও বিশেষজ্ঞ হিসাবে নয়, জেনারেল প্র্যাকটিসনার হিসাবে।
১৯৯৩ সালে হাইডে নিজের প্র্যাকটিস শুরু করেন হ্যারল্ড। প্রায় তিন হাজার রোগীকে দেখেছিলেন তিনি। ১৯৯৮ সালে ক্যাথলিন গ্রান্ডি নামে এক মহিলাকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হন হ্যারল্ড।
২০০২ সালে তদন্ত শুরু হয় হ্যারল্ডের বিরুদ্ধে। সেই তদন্তে দেখা গিয়েছে, ১৯৯৯ সালেই তিনি ১৫ জন রোগীকে খুন করেন।
প্রথম সন্দেহ জেগেছিল ডেবোরা ম্যাসি নামে এক মহিলার। সময়টা ১৯৯৮ সালের মার্চ। শেষকৃত্য করে এমন একটি সংস্থায় কাজ করতেন ডেবোরা। তিনি লক্ষ করেন, তার আগের কয়েক বছরে মৃতদের মধ্যে একটা বড় অংশ হ্যারল্ডের চিকিৎসাধীনে ছিলেন। পুলিশকে তিনি সে কথা জানান। পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও প্রমাণের অভাবে বন্ধ করে দেয়।
১৯৯৮ সালের অগস্টে একই সন্দেহ হয় এক ট্যাক্সি চালকের। জন শ নামে ওই চালক পুলিশকে বলেন, অনেক প্রবীণ মহিলাকে তিনি হ্যারল্ডের চেম্বারে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের মৃত্যু হয়েছিল বলে পরে জানতে পারেন। জনের দাবি, মৃত্যু হওয়ার মতো অসুস্থ তাঁরা কেউই ছিলেন না।
ওই বছরেই নিজের বাড়িতে মৃত্যু হয় ক্যাথলিন গ্রান্ডির। ১৯৯৮ সালের জুনে। গ্রান্ডির চিকিৎসা করেছিলেন হ্যারল্ড।
ক্যাথলিনের মেয়ে অ্যাঞ্জেলা উড্রাফ পেশায় এক আইনজীবী। মায়ের মৃত্যুর পর তিনি জানতে পারেন, ক্যাথলিন সব সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছেন চিকিৎসককে। এর পরেই সন্দেহ বাড়ে অ্যা়ঞ্জেলার। তিনি জানান পুলিশকে।
পুলিশ ময়নাতদন্ত করায় ক্যাথলিনের দেহের। তাতে ওই প্রবীণার শরীরে হেরোইন (ডায়মরফিন) মিলেছিল। ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয় এই ডায়মরফিন।
পুলিশের জেরায় হ্যারল্ড দাবি করেন, নেশা করতেন ক্যাথলিন। নিয়মিত মরফিন, হেরোইন খেতেন। যদিও পুলিশ সে প্রমাণ পায়নি। ক্যাথলিনের বাড়িতে গিয়ে তারা বুঝতে পারে, তাঁর টাইপরাইটার ব্যবহার করে ভুয়ো উইল তৈরি করেছিলেন হ্যারল্ড।
এর পর হ্যারল্ডের ১৫ জন রোগীর মৃত্যু অনুসন্ধানে নামে পুলিশ। প্রত্যেকের শরীরেই মেলে ডায়মরফিন। প্রত্যেক রোগীর প্রেসক্রিপশনেই হ্যারল্ড লিখে রেখেছিলেন, তাঁরা গুরুতর অসুস্থ।
১৯৯৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন হ্যারল্ড। ২০০০ সালে তাঁকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়।
২০০১ সালের ইংল্যান্ড সরকার রিপোর্ট দিয়ে জানায়, ২৩৬ জন রোগীকে খুন করেছিলেন হ্যারল্ড।
২০০৪ সালের জানুয়ারিতে ওয়েকফিল্ড জেলেই আত্মহত্যা করেন হ্যারল্ড।
সংবাদমাধ্যমের দাবি, আত্মহত্যার আগে পুলিশকর্মীদের হ্যারল্ড জানিয়েছিলেন, তাঁর স্ত্রী যাতে অবসরভাতা পান, তাই আত্মহত্যা করেছেন।