দশমীর রাতে বান্ধবীর বাড়িতে যাওয়াই কাল হল হরিদেবপুরের অয়ন মণ্ডলের। ‘বান্ধবীর বাড়ি থেকে আসছি’ বলে সেই যে বেরোন অয়ন, আর ফেরেননি। দ্বাদশীর দিন শুক্রবার বাড়ির বহু দূরে মগরাহাটে তার দেহ উদ্ধার হয়। উৎসবের আবহে এই রহস্যমৃত্যু ঘিরেই হইচই পড়ে গিয়েছে কলকাতা তথা রাজ্যে। ইতিমধ্যেই তদন্তে উঠে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অয়নকে খুন করেছেন বান্ধবী ও তার পরিবারের সদস্যরা— এই অভিযোগ করেছেন হরিদেবপুরের যুবকের পরিবার। তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই ফুটে উঠছে এই ঘটনার পরতে পরতে রহস্য। দাবি, পাল্টা দাবির বন্যা।
বান্ধবীর মায়ের সঙ্গেও অয়নের কি প্রেমের সম্পর্ক ছিল? খুনের ঘটনার তদন্তে নেমে এখন এই প্রশ্নই ভাবাচ্ছে পুলিশকে। অয়নের এক বন্ধু প্রথম দাবি করেছেন যে, বান্ধবী ও বান্ধবীর মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল নিহত যুবকের।
তা হলে কি ত্রিকোণ সম্পর্কের টানাপড়েনেই এই পরিণতি হল অয়নের? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ারই চেষ্টা করছে পুলিশ। ওই বন্ধুর দাবি, ত্রিকোণ সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছিলেন অয়নের বান্ধবীর বাবা। তবে এই দাবি আদৌ সত্য কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর।
ত্রিকোণ সম্পর্কের চাঞ্চল্যকর দাবির মধ্যেই অয়ন মণ্ডলের রহস্যমৃত্যুতে আরও এক নতুন তথ্য হাতে পেয়েছে পুলিশ। দশমীর রাতে নাকি মত্ত অবস্থায় বান্ধবীর বাড়িতে গিয়েছিলেন অয়ন।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, দশমীতে রাত ১১টা নাগাদ মত্ত অবস্থায় বান্ধবীর রমাকান্তপুরের উদয়াঞ্চলের বাড়িতে যান অয়ন। কিন্তু সে সময় তাঁর বান্ধবী বাড়িতে ছিল না। সে কারণে নাকি বিরক্ত হয়ে বান্ধবীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়ান অয়ন। পরে বান্ধবী ফিরলে তাঁকে মারধর করেন অয়ন। বান্ধবীর মা রুমা জানাকেও মারধর করেন ওই যুবক।
বাড়িতে চিৎকার শুনে ঘরে গিয়ে অয়নকে রোখার চেষ্টা করে বান্ধবীর ভাই। কিন্তু তাঁকে সামলানো যায়নি। এই অবস্থায় দিদি ও মায়ের কথা মতোই ভারী বস্তু দিয়ে অয়নের মাথায় আঘাত করে বান্ধবীর ভাই। এর পরই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন অয়ন। পুলিশ সূত্রে এমনটাই জানা গিয়েছে।
পুলিশ সূত্রে খবর, অয়ন মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পরই সেখানে যান বান্ধবীর বাবা দীপক জানা। ছেলের দুই বন্ধুকে ডাকতে বলেন দীপক। সেই মতো দুই বন্ধুকে ডাকে বান্ধবীর ভাই। এর পর বান্ধবীর ভাইয়ের দুই বন্ধু দু’হাজার টাকায় পণ্যবাহী একটি গাড়ি ভাড়া করে।
গাড়িচালককে বান্ধবীর পরিবারের সদস্যরা জানান যে, বাড়ির কিছু জিনিস নিয়ে যাওয়া হবে গাড়িতে। গাড়িতে মৃতদেহ তোলা হচ্ছে, এটা বুঝতে পেরেই বেঁকে বসেন চালক। কিন্তু আরও বেশি টাকার লোভে রাজি হয়ে যান চালক।
সূত্রের খবর, ওই গাড়িতে করে অয়নের দেহ নিয়ে গিয়ে মগরাহাটের কাটপোলের কাছে করিমাবাদে ফেলে দেওয়া হয়। মগরাহাটের ওই জায়গা থেকেই শুক্রবার পুলিশ অয়নের মৃতদেহ উদ্ধার করে।
দশমীর রাতে অয়নের সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল, এ নিয়ে মুখ খুলেছে তাঁর এক বন্ধু রাজু। সে দিন গভীর রাত পর্যন্ত অয়নের সঙ্গে ছিলেন তিনি। তাঁর দাবি, দশমীতে রাত ৯টা-সাড়ে ৯টা নাগাদ তিনি অয়নের সঙ্গে তাঁর বান্ধবীর হরিদেবপুরের নতুনপল্লির বাড়িতে গিয়েছিলেন। রাজুকে বাড়ির বাইরে দাঁড় করিয়ে ভিতরে ঢুকেছিলেন অয়ন।
বান্ধবীর বাবা ওই রাস্তায় এলে তাঁকে যাতে আগাম জানানো হয়, সে কথা রাজুকে বলেন অয়ন। রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ বান্ধবীর বাবাকে দেখতে পেয়ে অয়নকে সজাগ করেছিলেন রাজু। কিন্তু অয়ন বান্ধবীর বাড়ি থেকে বেরোননি। রাজুর দাবি, বাড়ির বাইরে বেরোনোর পরিস্থিতি হয়নি বলে জানান অয়ন। বান্ধবীর বাবার হাত থেকে ধরা পড়া থেকে বাঁচতে সে বাড়ির ছাদে লুকিয়েছিলেন অয়ন।
রাজু আরও জানিয়েছেন যে, বান্ধবীর বাবা ঘুমিয়ে পড়লে রাত ২টো নাগাদ অয়ন বেরোবে বলে জানান। কিন্তু রাত দেড়টা নাগাদ ফোনে কাঁদতে কাঁদতে অয়ন রাজুকে জানান যে, তাঁকে মারধর করা হয়েছে। বুকে ব্যথা হচ্ছে।
বন্ধুর মুখে এ কথা শুনে দলবল নিয়ে বান্ধবীর বাড়িতে ঢুকবেন কি না অয়নকে জিজ্ঞাসা করেন রাজু। কিন্তু বন্ধুর সেই প্রস্তাব পত্রপাঠ খারিজ করেন অয়ন। এর পর রাত ৩টে ৩ মিনিট নাগাদ আবার রাজুকে ফোন করেন অয়ন। রাজুর দাবি, অয়ন তাঁকে জানায়, পাড়ায় কিছু ঝামেলা হচ্ছে। রাজু যেন সেই ঝামেলায় জড়িয়ে না পড়েন। এর পর আর অয়নের সঙ্গে তাঁর কথা হয়নি। তার পর থেকেই অয়ন বেপাত্তা হয়ে যান।
রাজুর এই দাবি খতিয়ে দেখছে পুলিশ। শুক্রবার এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরই হরিদেবপুরে উত্তেজনা ছড়ায় বান্ধবীর বাড়িতে ভাঙচুর চালান উত্তেজিত জনতা। বান্ধবীর প্রতিবেশীর বাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়।
এই ঘটনায় শুক্রবার রাতেই অয়নের বান্ধবী, তাঁর মা ও ভাইকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শনিবার সকালে বান্ধবীর বাবা, বান্ধবীর ভাইয়ের এক বন্ধু ও এক পণ্যবাহী গাড়িচালককে গ্রেফতার করা হয়। ওড়িশা থেকে বান্ধবীর ভাইয়ের আরও এক বন্ধুকে পাকড়াও করা হয়েছে।
ঠিক কী ঘটেছিল অয়নের সঙ্গে? খুনের আসল কারণ কী? ধৃতদের জেরা করলে এ সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য জানা যেতে পারে বলে মনে করছে পুলিশ। এরই মধ্যে প্রকাশ্যে আসে অয়নের মায়ের দাবি। অয়নের মা দাবি করেন, অয়নের বান্ধবী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। নিজে মুখেই তিনি অয়নের মা-কে এ কথা জানিয়েছিলেন। সত্যিই তিনি অন্তঃসত্ত্বা, না কি অন্য কোনও কারণে এই কথা তিনি বলেছিলেন, তা তদন্ত করে দেখছে পুলিশ।