প্রথমে ইসমাইল হানিয়ে। তার পর ইয়াহিয়া সিনওয়ার। এক এক করে প্যালেস্তিনীয় জঙ্গি গোষ্ঠী ‘হামাস’-এর নেতাদের খুঁজে খুঁজে নিকেশ করছে ইজ়রায়েল। ফলে রীতিমতো নেতৃত্বের সঙ্কটে পড়ে গিয়েছে ইরানের মদতপুষ্ট এই সংগঠন।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও হামাস, ‘ভাঙব তবু মচকাবো না’ অবস্থান নেওয়ায় পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত শূন্য বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। কারণ, ইহুদিদের সমূলে বিনাশ করতে নতুন মুখের খোঁজ শুরু করে দিয়েছে প্যালেস্তিনীয় জঙ্গি গোষ্ঠী।
সূত্রের খবর, সিনওয়ারের জায়গায় এমন রাজনৈতিক নেতাকে আনাতে চাইছে হামাস, যিনি গাজ়ার বাইরে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন। কারণ, ইতিমধ্যেই গাজ়া ভূখণ্ডের অধিকাংশ জায়গা দখল করে নিয়েছে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। ফলে ইহুদি ফৌজের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সেখানে বসে দল চালানো যে একরকম অসম্ভব, তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে হামাস।
আর তাই প্যালেস্তানীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর শীর্ষ পদে বসার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন মাহমুদ আল-জ়াহার। হামাসের এই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কট্টরপন্থী নেতা হিসেবেই পরিচিত। শুধু তাই নয়, সংগঠনের আদর্শগত দিকটিকে ধারাল করতে তিনিই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন।
হামাসের মূলত দু’টি উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, জঙ্গি হামলার মাধ্যমে ইজ়রায়েলকে দুনিয়ার মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা। দ্বিতীয়ত, গাজ়ায় পুরোপুরি ইসলামীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করা। সেই লক্ষ্যে ২০০৬ সালে প্যালেস্টাইনের আইনসভার নির্বাচনে ঝাঁপিয়েছিল এই জঙ্গি গোষ্ঠী।
ওই ভোটের অন্যতম ‘বড় খিলাড়ি’ ছিলেন আল-জ়াহার। মূলত, তাঁর নেতৃত্বেই গাজ়ায় উল্কার গতিতে উত্থান হয় হামাসের। ফলে আমজনতার মধ্যে ‘মসীহা’-র জায়গা পান জঙ্গি নেতারা। নির্বাচনে হামাস জয়ী হলে সেখানকার প্রথম বিদেশমন্ত্রী ছিলেন আল-জ়াহার।
এহেন আল-জ়াহারকে সরিয়ে দিতে কম চেষ্টা করেনি ইহুদি গুপ্তচর সংস্থা ‘মোসাদ’। ১৯৯২ ও ২০০৩ সালে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে তাঁরা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দু’বারই প্রাণে বেঁচে যান জ়াহার। হামাসের রাজনৈতিক সংগঠনের তিনি যে একজন বড় নেতা,তা মানে ইজ়রায়েলি সরকারও।
তবে সিনওয়ারের উত্তরসূরীর দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন তাঁর ভাই মহম্মদ সিনওয়ারও। ইয়াহিয়ার মতো তিনিও দীর্ঘদিন ধরেই হামাসের ফৌজি শাখার দীর্ঘদিনের কমান্ডার। প্যালেস্তানীয় জঙ্গিদের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে কৌশলগত উন্নতিতে তাঁর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
আমেরিকার সেনা আধিকারিকদের দাবি, মহম্মদ সিনওয়ার নিহত ইয়াহিয়ার স্থালাভিষিক্ত হলে হামাস-ইজ়রায়েল যুদ্ধ বিরতির দর কষাকষি আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কারণ, কট্টরপন্থার নিরিখে দাদার চেয়ে আরও এক কাঠি দর এই মহম্মদ।
আল-জ়াহারের মতো মহম্মদ সিনওয়ারকেও বহুবার হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে মোসাদ। হামাসের এই ফৌজি নেতা খুবই প্রচার বিমুখ। যদিও প্রায় প্রতিটি জঙ্গি হামলার পিছনে তাঁর মস্তিষ্ক রয়েছে বলে মনে করেন দুঁদে ইজ়রায়েলি গোয়েন্দারা।
হামাসকে নেতৃত্ব দেওয়ার লড়াইতে রয়েছেন দলের বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা মৌসা আবু মারজ়ুক। ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে ‘প্যালেস্তানীয় মুসলিম ব্রাদারহুড’ ভেঙে বেরিয়ে এসে হামাস প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। একটা সময়ে হামাসের রাজনৈতিক সংগঠনের মাথায় ছিলেন আবু মারজ়ুক। জঙ্গি হামলার অর্থের জোগান তাঁর হাত ধরে আসে বলে জানা গিয়েছে।
১৯৯০-এর দশকে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকায় অভিযোগে আবু মারজ়ুককে জেলে পাঠায় আমেরিকা। পরবর্তীকালে লম্বা সময়ের জন্য জর্ডনে নির্বাসিত ছিলেন তিনি। কিন্তু তার পরও হামাসে তাঁর প্রভাব এতোটুকু কমেনি। বরং তাঁর কথায় জীবন পর্যন্ত বাজি রাখতে পারে এই সংগঠনের তরুণ জঙ্গি যোদ্ধারা।
হামাসের জঙ্গি ফৌজের কুখ্যাত শাখা হল ‘ইজ় আল-দিন আল-কাসাম’ ব্রিগেড। যাঁর নেতৃত্বে থাকা মহম্মদ দেইফও সংগঠনের মাথায় বসার অধিকারী। গত বছরের (পড়ুন ২০২৩) ৭ অক্টোবর ইহুদি ভূমিতে যে ভয়ঙ্কর হামলা হয়েছিল, তার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এই দেইফ।
আইডিএফের অবশ্য দাবি, চলতি বছরের অগস্টে বিমান হামলায় মৃত্যু হয়েছে আল-কাসাম ব্রিগেডের প্রধান কমান্ডারের। তবে তাঁর মৃতদেহ হাতে পায়নি ইহুদি ফৌজ। সূত্রের খবর, ওই বিমান হানায় গুরুতর জখম হলেও প্রাণে বেঁচে যান দেইফ। বর্তমানে গোপন ডেরা থেকে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন তিনি।
হামাসের রাজনৈতিক শাখার আরেক বড় নেতা হলেন খলিল আল-হাইয়া। তাঁকে এবার সর্বোচ্চ কুর্সি দিতে পারে এই প্যালেস্তানীয় জঙ্গি গোষ্ঠী। ২০১৪ সালে কাতারের দোহায় হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষ বিরতিতে রাজি হয় ইজ়রায়েল। তখন ইহুদিদের উপর চাপ তৈরি করার অন্যতম কারিগর ছিলেন হাইয়া।
২০০৭ সালে আইডিএফের বিমান হানায় প্রাণে বেঁছে যান হাইয়া। তবে প্রাণ হারান তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এর পরই নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে হামাসে রাজনৈতিক উত্থান হয় তাঁর। ফলে তাঁকে সংগঠনের শীর্ষে রাখলে ফের ইহুদিদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি সম্ভব বলে মনে করে এই প্যালেস্তানীয় জঙ্গি গোষ্ঠী।
২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হামাসকে নেতৃত্ব দেন খালেদ মাশাল। কিন্তু পরবর্তীকালে দলের মধ্যে সমস্যা তৈরি হওয়ায় তাঁকে একরকম তাড়িয়েই দিয়েছিল এই প্যালেস্তানীয় জঙ্গি গোষ্ঠী। বর্তমানে পরিস্থিতি ফের খালেদকে শীর্ষপদ দিয়ে আগের জায়গায় ফেরালে অবাক হওয়ার কিছু নেই, বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা।
খালেদের সময়ে রাজনৈতিক ও সামরিক, দু’টি ক্ষেত্রেই পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে পেরেছিল হামাস। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়ে সেখানকার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের প্রকাশ্যে সমালোচন করেন তিনি। যা ইরানের সঙ্গে হামাসের সম্পর্কে সামান্য চিঁড় ধরিয়েছিল।
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ওই কারণেই হামাস থেকে বিতাড়িত হন খালেদ। কারণ, এই প্যালেস্তানীয় জঙ্গি গোষ্ঠীটির মূল আর্থিক ও সামরিক মদতদাতা হল ইরান। বর্তমানে কাতারে রয়েছেন খালেদ। দল ছাড়লেও হামাসে তাঁর অন্ধ ভক্তের সংখ্যা নেহাত কম নয়।