‘মন্নত’-এর জালে ঘেরা বারান্দা। দু’পাশে দু’হাত ছড়িয়ে হাসিমুখে জ্বলজ্বল করছেন তিনি। সামনে থিক থিক করছে ভিড়, ভিড়ে জমা ভালবাসা। সকলেই তাঁকে একটি বার দেখার আশায়। তিনি শাহরুখ খান।
কিন্তু শাহরুখের নাম শুনে তাঁর পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বলিপাড়ার এক জনপ্রিয় অভিনেতার ভাই। তাঁর প্রশ্ন ছিল, ‘‘শাহরুখ খান! তিনি আবার কে?’’ এই প্রশ্ন করেছিলেন ধর্মেন্দ্রের তুতো ভাই গুড্ডু ধানোয়া। বলিপাড়ার নামকরা প্রযোজকদের মধ্যে অন্যতম হলেন গুড্ডু।
গুড্ডু এবং শাহরুখের কাহিনি জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হয় আশির দশকে। বড় পর্দায় নয়, সেই সময় ছোট পর্দায় রাজত্ব করছিলেন শাহরুখ। ‘ফৌজি’ এবং ‘সার্কাস’ ধারাবাহিকে অভিনয় করে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি।
শাহরুখের চোখে তখন সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন। টেলিভিশনের পর্দা ছেড়ে তখন তিনি হিন্দি ছবিতে কাজ করা শুরু করেছেন। এমনকি, বলিপাড়ার ছবি নির্মাতাদের কাছ থেকে প্রস্তাবও পেয়ে গিয়েছেন। কোনও কোনও ছবির শুটিংও শুরু হয়ে গিয়েছে।
পাশাপাশি ‘দিওয়ানা’ ছবিরও শুটিং শুরু করে দিয়েছেন পরিচালক রাজ কানওয়ার। এই ছবির প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন গুড্ডু। এই ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যায় ঋষি কপূর, দিব্যা ভারতী এবং শাহরুখ খানকে।
কিন্তু ছবি নির্মাতাদের প্রথম পছন্দ ছিলেন না শাহরুখ। দ্বিতীয় অভিনেতা হিসাবে বলি পরিচালক রাজকুমার কোহলির পুত্র আরমান কোহলিকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন রাজ এবং গুড্ডু। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সইসাবুদও করে ফেলেছিলেন আরমান।
কিন্তু আরমান শুটিংয়ের মাঝপথে কাজ ছেড়ে দেন। পুরনো এক সাক্ষাৎকারে গুড্ডু জানান যে, তাঁর বন্ধু ললিত কপূরের স্ত্রী শবনম একই সময়ে ‘ইনসাফ কি দেবী’ ছবির শুটিং করছিলেন। সেই ছবিতেও অভিনয় করছিলেন আরমান।
কিন্তু ‘ইনসাফ কি দেবী’ ছবির শুটিংয়ের সেটে শবনমের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় আরমানের। অভিনেতাকে কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেন শবনম। রাগের বশে ‘দিওয়ানা’ ছবির কাজও ছেড়ে দেন আরমান।
সাক্ষাৎকারে গুড্ডু বলেন, ‘‘এক সন্ধ্যায় রাজকুমার আমাকে ফোন করে তাঁর পুত্রের সঙ্গে শবনমের বচসার কথা জানালেন। শবনম কাজ থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন বলে আরমান আর ‘দিওয়ানা’ ছবিতেও কাজ করবেন না বলে জানিয়ে দেন রাজকুমার।’’
আরমান চলে যাওয়ার পর মাথায় হাত পড়ে গুড্ডুর। ইতিমধ্যেই ছবির কিছুটা অংশ শুট করা হয়ে গিয়েছে। এ বার কোন অভিনেতাকে রাজি করাবেন, সেই চিন্তা নিয়ে বলি পরিচালক শেখর কপূরের সঙ্গে চেন্নাইয়ের উদ্দেশে যাত্রা করছিলেন গুড্ডু।
‘অঞ্জলি’ ছবির স্পেশাল এফেক্টসের কাজের জন্য একসঙ্গে চেন্নাই যাচ্ছিলেন গুড্ডু এবং শেখর। গুড্ডু যে নতুন মুখের সন্ধানে রয়েছেন সে কথা শেখরকে জানালেন তিনি। শেখর তখন শাহরুখের কথা জানিয়েছিলেন গুড্ডুকে।
কিন্তু শাহরুখের নাম কখনও শোনেননি গুড্ডু। শেখরের মুখে শাহরুখের প্রশংসা শোনার পর গুড্ডু জানতে চান কে এই শাহরুখ খান? শাহরুখের পরিচয় জানার পর গুড্ডু বলেন, ‘‘আমি হয়তো ওঁর অভিনয় দেখেছি। কিন্তু খেয়াল পড়ছে না।’’
শেখর বার বার গুড্ডুকে অনুরোধ করেন যেন তিনি শাহরুখকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। অবশেষে শেখরের কথা মেনে শাহরুখের সঙ্গে কথা বলেন গুড্ডু। কিন্তু শাহরুখ জানিয়ে দেন যে, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হলে দিল্লি যেতে হবে।
দিল্লির একটি বিলাসবহুল রেস্তরাঁয় শাহরুখের সঙ্গে দেখা করতে যান রাজ এবং গুড্ডু। ঘড়ির কাঁটা মেনে যথাস্থানে হাজির ছিলেন শাহরুখ। প্রথম দর্শনেই শাহরুখকে দেখে পছন্দ হয়ে যায় গুড্ডুর। তিনি সেই মুহূর্তেই রাজকে বলেন, ‘‘শাহরুখই আমার ছবির নায়ক হবে।’’
‘দিওয়ানা’ ছবিতে অভিনয়ের কথা শাহরুখকে বলতেই তিনি জানিয়ে দেন যে, তাঁর হাতে ইতিমধ্যেই প্রচুর ছবির কাজ রয়েছে। ‘রাজু বন গয়া জেন্টলম্যান’, ‘চমৎকার’, ‘কভি হাঁ কভি না’, ‘দিল আশনা হ্যায়’ এবং ‘কিং আঙ্কল’ ছবির শুটিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন অভিনেতা।
সময় বার করতে পারবেন না জেনেও রাজ এবং গুড্ডু ‘দিওয়ানা’ ছবির চিত্রনাট্য শোনার জন্য অনুরোধ করলেন শাহরুখকে। শাহরুখ তাঁদের দু’জনকে পরের দিন নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। চিত্রনাট্যের দ্বিতীয়ার্ধে শাহরুখের প্রবেশের উল্লেখ ছিল। কিন্তু চিত্রনাট্যের প্রথম অংশ শোনার পর শাহরুখ তাঁদের দুপুরের খাবার খেতে অনুরোধ করেন।
মধ্যাহ্নভোজের পর ‘দিওয়ানা’ ছবির চিত্রনাট্যের দ্বিতীয় ভাগটি শোনেন শাহরুখ। স্ক্রিপ্ট শোনার পর এই ছবিতে কাজ করতে চান তিনি। কিন্তু কোনও ভাবেই সময় বার করতে পারছিলেন না।
শেষ পর্যন্ত শাহরুখ বলেন, ‘‘আমার হাতে থাকা ছবিগুলির মধ্যে যদি একটি ছবির কাজ পিছিয়ে যায় বা বাতিল হয়ে যায়, তবে আমি ‘দিওয়ানা’র শুটিংয়ের জন্য সময় বার করতে পারব।’’
‘দিওয়ানা’ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান শাহরুখ। ১১ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে কাগজপত্রেও অভিনেতাকে দিয়ে সই করিয়ে নেন রাজ এবং গুড্ডু। কেরিয়ারের শুরুতেই ছ’টি ছবিতে সই করে ফেলেছিলেন শাহরুখ।
কিন্তু শাহরুখের হাতে ‘দিওয়ানা’ ছাড়া আরও পাঁচটি ছবির কাজ থাকলেও সবার আগে মুক্তি পায় ‘দিওয়ানা’ই। কারণ, শাহরুখ আসার আগে ছবির কাজ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। বাকি ছিল শাহরুখের দৃশ্যগুলিই। তাই তাড়াতাড়ি ছবির শুটিং শেষ হয়ে যায়।
বলিপাড়া সূত্রে খবর, ‘দিওয়ানা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ঋষি ১০ লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক আদায় করেছিলেন। অন্য দিকে, শাহরুখ এই ছবিতে অভিনয় করে দেড় লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক পান।
১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর রাতারাতি বলিপাড়ায় প্রচারে চলে আসেন শাহরুখ। বক্স অফিসে এই ছবি সাড়াও ফেলে দুর্দান্ত। ছবির সাফল্যের পর শাহরুখ ইন্ডাস্ট্রির পরিচিত মুখ হয়ে যান।
‘দিওয়ানা’ ছবির সাফল্য প্রসঙ্গে গুড্ডু এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘ভগবান আগে থেকেই সবকিছু ভাগ্যে লিখে রেখেছিল। ভাগ্যের লিখন কি বদলানো যায়?’’ এর পর প্রযোজনার পাশাপাশি পরিচালনাও করতে দেখা গিয়েছে গুড্ডুকে। ‘বিচ্ছু’, ‘জিদ্দি’, ‘২৩ মার্চ ১৯৩১: শহিদ’ ছবিগুলির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি।