কুস্তিগীর বীরেন্দ্র সিংহ চান তাঁকে লোকে ‘বোবা পালোয়ান’ বলেই ডাকুক। তিনি মনে করেন, কথা বলতে না পারাটা তাঁর শারীরিক অক্ষমতা হতে পারে, কিন্তু দুর্বলতা একেবারেই নয়।
দেশকে অলিম্পিকে তিনটি সোনা একটি ব্রোঞ্জ এনে দিয়েছেন বীরেন্দ্র। শারীরিক অক্ষমতা নিয়েই তা করে দেখিয়েছেন তিনি। ‘বোবা’ শব্দটা বার বার শুনতে চাওয়া হয়তো সে জন্যই।
মূক-বধির হয়েও সফল কুস্তিগীর হওয়ার লড়াইকে প্রতি মুহূর্তে মনে রাখতে চান তিনি। একইসঙ্গে সমালোচকদেরও মনে করিয়ে দিতে চান তাঁর সাফল্যের কথা।
জন্ম থেকেই মূক-বধির বীরেন্দ্র। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁর কাছে বাধা হলেও বড় প্রতিকূলতা তৈরি করতে পারেনি।
বিপক্ষের পালোয়ানের পরবর্তী পদক্ষেপ নিঃসারেই বুঝে নেন তিনি। বীরেন্দ্রর বিপন্নতার আসল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর প্রতি কিছু মানুষের অনাস্থা।
মূক-বধির বলে ছোট থেকেই সমবয়সিদের তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন।পরে পালোয়ান বীরেন্দ্র যখন একের পর এক কুস্তি প্রতিযোগিতা বা ‘দঙ্গল’-এ অংশ নিয়ে প্রতিযোগীদের কুপোকাত করছেন, জাতীয় স্তরের চ্যাম্পিয়ন হচ্ছেন, তিনি দেখলেন তখনও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। তার পরও একই ধরনের তাচ্ছিল্যের শিকার তিনি।
হরিয়ানার ঝাঝড়ের সাসরোলি গ্রামে বীরেন্দ্রর জন্ম। কুস্তি নিয়ে তাঁদের পরিবার চর্চা করছে বংশানুক্রমে। বাবা সিআইএসফের জওয়ান ছিলেন। তিনিও অবসরে কুস্তি অভ্যাস করতেন। কুস্তিতে বীরেন্দ্রর আগ্রহ তৈরি হওয়া তাই কিছুটা স্বাভাবিকই ছিল।
বন্ধুদের কাছে অপদস্থ হতে থাকা বীরেন্দ্রকে তাঁর কাকা প্রথম নিয়ে আসেন কুস্তির আখড়ায়। দিল্লিতে সিআইএসএফ-এর কুস্তির আখড়ায় প্রথম প্রশিক্ষণ শুরু হয় ১২ বছরের বীরেন্দ্রর। আর তিন বছরের মধ্যেই কুস্তিগীরদের অন্যতম সম্মান ‘নও শের’ উপাধি লাভ করেন তিনি।
ন’সপ্তাহে টানা ন’টি দঙ্গলে জয়ী হলে তাকেই ‘নয় সিংহ’ বা ‘নও শের’ উপাধি দেওয়া হয়। ১৫ বছরের বীরেন্দ্র তখনই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর যোগ্যতা রয়েছে। তবে বাকিরা বোঝেননি বা বুঝতে চাননি। বড় কোনও সুযোগ তাই আসেনি বীরেন্দ্রর কাছে।
২০০১ সালে ৭৬ কেজি বিভাগে ন্যাশনাল ক্যাডেট চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ী হন বীরেন্দ্র। অন্য কেউ হল এই জয় জীবন বদলে দিতে পারত। বীরেন্দ্রর ক্ষেত্রে তা হয়নি। তাঁকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হলে ভারতর রেসলিং ফেডারেশন সরাসরি নাকচ করে দেয়। যুক্তি ছিল, মূক-বধির বীরেন্দ্র ম্যাচের বাঁশি শুনতে পাবেন না।
বধিরদের জন্য আলাদা অলিম্পিকের আয়োজন করা হয়। নাম ডিফলিম্পিকস। ২০১২ সালে লন্ডনে এই অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় আমেরিকার তিন জন বধির কুস্তিগীর অংশ নেন। ভারতের তরফে বীরেন্দ্র সেখানে যেতেই পারতেন। কিন্তু আবারও বেঁকে বসে ফেডারেশন। এ বার তাদের যুক্তি, বীরেন্দ্র নাকি রেফারির নির্দেশ বুঝতে পারবেন না।
বীরেন্দ্র তার পরেও আশা ছাড়েননি। একের পর এক দঙ্গলে অংশগ্রহণ করে গিয়েছেন। সবক্ষেত্রে তাঁর প্রতিযোগী যে মূক-বধির ছিলেন তা-ও নয়।
২০০৫ সালে ডিফলিম্পিকসের কথা জানতে পারেন বীরেন্দ্র। নিজেই উদ্যোগী হন অংশগ্রহণ করার জন্য। এর পর ২০০৫ (মেলবোর্ন), ২০১৩ (বুলগেরিয়া) এবং ২০১৭ (তুরস্ক) সালে তিনটি ডিফলিম্পিক্সে সোনা জেতেন ‘বোবা পালোয়ান’। ২০০৯ সালে তাইপেইতে জেতেন ব্রোঞ্জ।
ততদিনে বীরেন্দ্রর কদর কিছুটা বুঝেছে ভারতের কুস্তিগীর ফেডারেশন। ২০১৬ সালে তাঁকে অর্জুন পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। ২০২১ সালে বীরেন্দ্রকে পদ্মশ্রী সম্মান দেয় কেন্দ্রীয় সরকার।
তবে বীরেন্দ্রর কাছে বড় সম্মান সম্ভবত ওই নামটাই। যাতে বলা রয়েছে তার অক্ষমতার কথা কিন্তু একইসঙ্গে অক্ষমতাকে হারিয়ে দেওয়ার কথাও। যার জোরে তাঁর প্রতি অনাস্থা দেখানো মানুষগুলোকে তিনি বাধ্য করেছেন তাঁকে সম্মানিত করতে।