মশার কারণে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। মশার বংশ নির্বংশ করার জন্য ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে একটি পরীক্ষা চালিয়েছিল ব্রাজ়িল। সাময়িক ভাবে সেই পরীক্ষা সফল হলেও শেষরক্ষা হয়নি। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় বলছে ওই পরীক্ষায় আদতে ডাহা ফেল করেছিল ব্রাজ়িল।
সমস্যা থেকে বাঁচতে জিনগত রূপান্তরিত মশা তৈরি করেছিল ব্রাজ়িল। বাহিয়া অঞ্চলের জেকোবিনা শহরে ছাড়া হয়েছিল সেই মশা। উদ্দেশ্য ছিল, সেগুলির মাধ্যমে এডিস ইজিপ্টাই মশার বংশ ধ্বংস করা। ওই প্রজাতির মশা থেকেই ছড়ায় ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, জিকার মতো রোগ।
এডিস মশা ধ্বংসের জন্য পুরুষ মশার জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন ব্রাজ়িলের বিজ্ঞানীরা। এর ফলে ওই পুরুষ মশার সঙ্গে সঙ্গম করলে স্ত্রী মশা বংশবিস্তারের ক্ষমতা হারাবে। যদি বা অপত্যের জন্ম দিতে পারে, তা বেশি দিন বাঁচবে না। এমনটাই দাবি করেছিলেন বিজ্ঞানীরা।
কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। স্ত্রী মশারা ধীরে ধীরে সতর্ক হয়ে ওঠে। তারা জিনগত রূপান্তর ঘটেছে এমন পুরুষ মশার সঙ্গে সঙ্গম এড়িয়ে চলতে থাকে। রূপান্তরিত মশাগুলির মৃত্যুর পর ফের নতুন করে বংশবিস্তার শুরু করে মশারা।
উষ্ণ অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে মশা বড় অভিশাপ। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, জিকার মতো রোগ ছড়ায় তারা। অনেক সময় ডেকে আনে মৃত্যু। বিজ্ঞানীরা জিনগত প্রযুক্তির মাধ্যমে এই মশা ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কয়েকটি গবেষণা বলছে, এডিস মশা পৃথিবীর বুক থেকে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলেও বাস্তুতন্ত্রের কোনও ক্ষতি হবে না।
জেকবিনায় জিনগত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মশা ধ্বংসের চেষ্টা করেছিল ব্রাজ়িল সরকার। ঠিক কী হয়েছিল? একটি ব্রিটিশ সংস্থা ব্রাজ়িল সরকারের অনুমতি নিয়ে প্রতি সপ্তাহে ওই শহরে সাড়ে চার লক্ষ পুরুষ মশা ছাড়ত, যাদের জিনগত রূপান্তর হয়েছিল।
২০১৩ সালের জুন থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৭ মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে এই কাজ করেছিল সংস্থা।
এই পুরুষ মশাদের জিনগত পরিবর্তন এমন ভাবে করা হয়েছিল যে, তাদের সঙ্গে সঙ্গমের ফলে জন্মানো পরবর্তী প্রজন্ম (এফ১) পরিণত বয়সে পৌঁছনোর আগেই মারা যাবে। ওই প্রজন্ম আর বংশবৃদ্ধি করতে পারবে না। জিনগত এই রূপান্তরকে বলা হয় ওএক্স৫১৩এ।
জিনগত রূপান্তরের কারণে নতুন প্রজন্মের শরীরে এক ধরনের প্রোটিন তৈরি হবে, যার রং ফ্লুরোসেন্ট। ফলে জঙ্গলে থাকলেও সহজেই ওই ধরনের মশাকে চেনা যাবে।
পরীক্ষার শুরুতে ১৮ মাস মশার সংখ্যা ভয়ঙ্কর ভাবে কমে যায়। প্রায় ৮৫ শতাংশ কমে যায় মশার সংখ্যা। এটাই চেয়েছিলেন গবেষকেরা।
কিন্তু ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা পরীক্ষা করে দেখেন, জিনগত ভাবে রূপান্তরিত মশা ছাড়া বন্ধ করা হলে ফের বৃদ্ধি পেতে থাকে মশার সংখ্যা।
পরীক্ষাগারে গবেষণায় দেখা গিয়েছিল জিনগত রূপান্তর ঘটেছে এমন পুরুষ মশার সঙ্গে সঙ্গমে যে সব মশা জন্মেছে, তাদের মধ্যে তিন থেকে চার শতাংশ বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তব দেখা গিয়েছে, এই সংখ্যাটা অনেক বেশি। এফ১ প্রজন্মের অনেক মশাই বংশবৃদ্ধি করতে পেরেছে।
পরীক্ষা চলাকালীন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকের ৩৪৭টি মশা জেকবিনা থেকে সংগ্রহ করে করেছিলেন। দেখা গিয়েছিল, অনেকগুলিরই জন্মদাতা জিনগত ভাবে রূপান্তরিত কোনও মশা।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে জিনগত ভাবে রূপান্তরিত মশা ছাড়া শেষ হয়। তার পর দেখা যায়, এফ১ মশার সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। খুব কম সংখ্যক মশায় রয়েছে ওএক্স৫১৩এ জিনোম। কারণ এফ১ প্রজন্মের বেশির ভাগ মশাই মরে গিয়েছে।
গবেষকেরা এ-ও দেখেন, নতুন প্রজন্মের মশার মধ্যে জিনের সংমিশ্রণ ঘটেছে। এর ফলে তাদের বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা বেড়েছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা আরও একটি বিষয় লক্ষ করেন। দেখেন, জিনগত ভাবে রূপান্তরিত পুরুষ মশাদের চিনে ফেলতে শুরু করেছে স্ত্রী মশারা। ফলে ওই মশার সঙ্গে তারা সঙ্গম এড়িয়ে চলছে। এর ফলে তাদের দু’জনের মিলনে নতুন এফ১ প্রজন্ম তৈরি হয়নি। জিনগত ভাবে রূপান্তরিত বহু পুরুষ মশা সঙ্গম না করেই মারা গিয়েছে।
এর ফলে পরীক্ষার ১৮ মাস পর দেখা যায়, জেকবিনায় আবার বৃদ্ধি পেয়েছে মশার সংখ্যা। ব্রিটেনের যে সংস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জিনগত ভাবে রূপান্তরিত মশা ছেড়েছিল, তারা এই দাবি মানেনি। বার বার দাবি করেছে, তাদের পরীক্ষা সফল হয়েছে। স্ত্রী মশা যে ওই মশার সঙ্গে সঙ্গম এড়িয়ে চলেছে তা-ও মানতে চায়নি তারা।