প্রথমে ছিল বিমানবন্দর। আর এ বার বিদ্যুৎ প্রকল্প। কেনিয়ায় ফের আর্থিক লোকসানের মুখে ভারতীয় শিল্পপতি তথা দেশের অন্যতম ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানি। তাঁর সংস্থার কাজের উপর স্থগিতাদেশ জারি করেছে পূর্ব আফ্রিকার দেশটির আদালত। এর প্রভাব আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের লেখচিত্রের উপরে পড়বে বলেও আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।
পূর্ব আফ্রিকার দেশটির বিদ্যুতের পরিকাঠামো খুব ভাল নয়। যা উন্নত করতে আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল কেনিয়ার সরকার। ঠিক হয়, ‘আদানি এনার্জি সলিউশন্স’-এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ পরিকাঠামো প্রকল্প গড়ে তুলবে সেখানকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। কিন্তু আদালতের রায়ে সেই চুক্তি ধাক্কা খেয়েছে।
উল্লেখ্য, আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে ‘কেনিয়া ইলেকট্রিক্যাল ট্রান্সমিশন কোম্পানি’র (কেট্রাকো) চুক্তি হয়েছিল। এই প্রকল্পের জন্য আদানি এনার্জিকে ৭৩ কোটি ৬০ লক্ষ ডলার দিতে রাজি ছিল পূর্ব আফ্রিকার দেশটির সরকার। পরিকাঠামো প্রকল্পের মধ্যে ‘ট্রান্সমিশন লাইন’ তৈরির কথা ছিল আদানি গোষ্ঠীর। আদালতের রায়তে যা অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঠান্ডা ঘরে গেল বলে মনে করা হচ্ছে।
কেট্রাকো এবং আদানি গোষ্ঠীর মধ্যে হওয়া চুক্তি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয় কেনিয়া ল’ সোসাইটি। চুক্তিটির শর্ত কর্মীদের সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী বলে অভিযোগ তোলেন তারা। পাশাপাশি, নানা কারণে তা গোপনীয়তার দোষে দুষ্ট বলেও দাবি করা হয়। চলতি বছরের ২৬ অক্টোবর এই মামলার রায় ঘোষণা করেছে কেনিয়ার হাই কোর্ট।
আফ্রিকার বিখ্যাত মাসাই উপজাতিদের দেশটিতে বেশ কিছু অদ্ভুত নিয়ম রয়েছে। যার অন্যতম হল, ২০২১ সালের সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা সংক্রান্ত আইন। তাতে বলা হয়েছে, বেসরকারি সহযোগিতায় করা সরকারি প্রকল্পের অনুমতি পাওয়ার ক্ষেত্রে সেখানকার আমজনতার যোগদান বাধ্যতামূলক। কেট্রাকো এবং আদানি এনার্জির মধ্যে হওয়া চুক্তিতে সেই নিয়ম ভাঙা হয়েছে বলে আদালতে জানিয়েছে কেনিয়া ল’ সোসাইটি।
এ প্রসঙ্গে কেনিয়ার হাই কোর্ট বলেছে, এই মামলার ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত চুক্তিটি নিয়ে এগোতে পারবে না কেনিয়ার সরকার। ৩০ বছরের মেয়াদে কেট্রাকো ও আদানি গোষ্ঠীর মধ্যে ওই চুক্তি হয়েছিল। শুনানি চলাকালীন ল’ সোসাইটির তরফে একে ‘সাংবিধানিক প্রতারণা’ ও ‘গোপনীয়তার সঙ্গে অবিচার’ বলে উল্লেখ করা হয়। এই প্রকল্পে কেনিয়াবাসীর ‘অর্থপূর্ণ যোগদান’ না থাকার যুক্তিও খাড়া করা হয়েছে।
দেশের বিদ্যুৎ পরিকাঠামো উন্নত করতে দরপত্র জারি করে কেনিয়ার জ্বালানি মন্ত্রক। আদানি এনার্জি সেই বরাত পেয়েছিল। এর পরই চলতি বছরের অক্টোবরের গোড়ায় কেট্রাকোর সঙ্গে ভারতীয় সংস্থার চুক্তি স্বাক্ষর হয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বিদ্যুতের ঘাটতি মিটবে বলে দাবি করেছিল জ্বালানি মন্ত্রক। যার জেরে মাঝেমধ্যেই ব্ল্যাকআউটের সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটিকে।
এর আগে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে জ়োমো কেনিয়াট্টা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চুক্তিভিত্তিক অধিগ্রহণের জন্য উদ্যোগী হয়েছিল গৌতম আদানির গোষ্ঠী। যা বাস্তবায়নে সাময়িক স্থগিতাদেশ জারি করেছে সেখানকার স্থানীয় একটি আদালত। চুক্তি বাস্তবায়িত হলে আগামী ৩০ বছরের জন্য এই বিমানবন্দরের মালিকানা থাকত আদানিদের হাতে।
আদানিদের সঙ্গে কেনিয়া সরকারের বিমানবন্দর নিয়ে চুক্তি হতেই সেখানকার কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। বিমানবন্দর অধিগ্রহণ হলে কর্মী ছাঁটাইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তাঁরা। ফলে সরকারের উপর চাপ তৈরি করতে ধর্মঘটের ডাক দেয় উড়ান ক্ষেত্রের কর্মী সংগঠন কেনিয়া অ্যাভিয়েশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন।
শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যাপক বিক্ষোভে শেষমেশ বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে সেদেশের আদালত। চুক্তিতে বিমানবন্দর সংস্কার এবং একটি অতিরিক্ত রানওয়ে তৈরির কথা ছিল আদানি গোষ্ঠীর। কিন্তু সেই দায়িত্ব ‘আদানি এয়ারপোর্ট হোল্ডিং লিমিটেড’-এর হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনায় স্থগিতাদেশের ফলে কেনিয়ায় আদানি গোষ্ঠী পা রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
পূর্ব আফ্রিকার উড়ান কর্মীদের দাবি, কেনিয়ার সরকার দেশের অন্যতম বড় ও গুরুত্বপূর্ণ এই বিমানবন্দরটিকে পুরোপুরি বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দিতে চায়। এ প্রসঙ্গে শ্রমিক ইউনিয়ন বলেছে, আদানির সঙ্গে চুক্তির ফলে চাকরি হারাতে হবে অনেক কেনীয় শ্রমিককে। এর ফলে কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ বাড়বে বিদেশি শ্রমিকদের।
অন্য দিকে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছে কেনিয়ার সরকার। তাঁদের দাবি, বিমানবন্দর বিক্রি করা হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, বিমানবন্দর সংস্কার চুক্তির ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এটি আসলে একটা সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ। বিমানবন্দর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কার হাতে থাকবে তা-ও চূড়ান্ত নয়। ৩০ বছরের মেয়াদে আদানি এয়ারপোর্টের সঙ্গে ১৫ হাজার ৫২৬ কোটি টাকার চুক্তি করেছিল কেনিয়া সরকার।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, বিমানবন্দরের চুক্তি নিয়ে কেনিয়ার এই কর্মী অসন্তোষের পিছনে রয়েছে চিনের উস্কানি। বেজিংয়ের ঋণের জালে বর্তমানে আটকে পড়েছে পূর্ব আফ্রিকার এই দেশ। আমেরিকার সংবাদপত্রগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চিনের কাছে কেনিয়ার ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা। চড়া সুদে ঋণ নেওয়ার ফলে সেই ধার শোধ করতে বেশ কয়েক বার কেনিয়াকে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার থেকে ঋণ নিতে হয়েছে।
চিনের ঋণের ফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য মোম্বাসা বন্দর বা অন্য একটি বিমানবন্দরের ৯০ শতাংশ মালিকানা চিনের হাতে তুলে দেবে কেনিয়া। সম্প্রতি এমনই একটি খবর সেখানকার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যদিও সেই দাবিকে নস্যাৎ করে দেয় সরকার। ঋণ মেটাতে কোনও ভাবেই বিদেশি রাষ্ট্রকে জাতীয় সম্পত্তি হস্তান্তর বা লিজ় দেওয়া হবে না। স্পষ্ট জানিয়েছে কেনিয়ার সরকার।
বিশ্লেষকরা কিন্তু এই যুক্তি পুরোপুরি মানতে নারাজ। তাঁদের কথায়, জ়োমো কেনিয়াট্টা বিমানবন্দর হাতিয়ে নেওয়ার প্রবল ইচ্ছে রয়েছে বেজিংয়ের। আর তাই ভারতীয় সংস্থার এন্ট্রি এই বিমানবন্দরে ঠেকাতে তৎপর হয়েছে শি জিনপিংয়ের দেশ। চুপিসারে পিছন থেকে শ্রমিক বিক্ষোভে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে, শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা বিমানবন্দরের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। চিনা ব্যাঙ্ক থেকেই উচ্চ সুদে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে যা তৈরি করেছে দ্বীপরাষ্ট্রের সরকার। খুব কম উড়ান ওঠানামা করায় যা বিশ্বের অন্যতম ‘খালি’ বিমানবন্দর হিসেবে পরিচিত। সূত্রের খবর, ভারত এবং রাশিয়ার দুই সংস্থাকে হামবানটোটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর লিজ় দিচ্ছে শ্রীলঙ্কা সরকার।
শ্রীলঙ্কার সরকারের সঙ্গে ভারত ও রাশিয়ার দু’টি সংস্থার ৩০ বছরের চুক্তি হয়েছে বলে খবর। এই চুক্তির টাকা থেকেই চিনের ঋণ শোধ করবে দ্বীপরাষ্ট্র। সেই রাস্তায় হেঁটে কেনিয়াও চেয়েছিল আদানির সঙ্গে চুক্তি করে লাভের অংশ চিনকে দিয়ে তাদের ঋণের বোঝা কমাতে, মত বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
কেনিয়ায় বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্বভার না পাওয়া আদানি গোষ্ঠী ধাক্কা খেয়েছিল। তবে তার প্রভাব আদানি এয়ারপোর্টের স্টকের সূচকে মারাত্মক ভাবে পড়েনি। কেনিয়ায় পরপর দু’টি প্রকল্প হাতছাড়া হওয়ার পর আর্থিক লোকসান শিল্পপতি গৌতম আদানি কী ভাবে সামলান, সেটাই এখন দেখার।