বোমা-পিস্তল নয়, এককালে তাঁর হাতে থাকত জীবনদায়ী ওষুধের শিশি-বোতল। মরণাপন্ন রোগীকে বাঁচিয়ে তোলাই ছিল তাঁর কাজ। কর্মজীবনের গোড়ায় তিনি বহু রোগীর ‘ত্রাতা’। তবে শেষ ভাগে তিনিই হয়ে ওঠেন উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ত্রাস— গ্যাংস্টার সঞ্জীব মহেশ্বরী জীবা ওরফে সঞ্জীব জীবা।
৭ জুন, বুধবার লখনউয়ের আদালত চত্বরে সঞ্জীবকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেন আইনজীবীর বেশধারী এক আততায়ী। গ্যাংস্টার তথা রাজনীতিক আতিক আহমেদের হত্যাকাণ্ডের ধাঁচেই তাঁর উপর চলে গুলির হামলা।
লখনউয়ের পুলিশ কমিশনার এসবি শিরদকর পরে সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘‘একটি মামলায় হাজিরা দেওয়ানোর জন্য লখনউয়ের জেলে বন্দি সঞ্জীবকে আদালতে আনা হয়েছিল। তাঁকে লক্ষ্য করে ছ’টি গুলি চালান এক অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী।’’
সঞ্জীবের উপর হামলার পর আদালত চত্বরেই অভিযুক্ত বিজয়কে ধরে ফেলে পুলিশের হাতে তুলে দেন কয়েক জন আইনজীবী। এই হামলায় আহত হন শিশু-সহ এক মহিলা ছাড়া দু’জন পুলিশকর্মী।
সঞ্জীবের পিঠ লক্ষ্য করে পর পর ছ’টি গুলি চালিয়েছিলেন বলে অভিযোগ বিজয় নামে উত্তরপ্রদেশের এক সুপারি কিলারের বিরুদ্ধে। ১৫ এপ্রিল আতিকের উপর হামলাকারীদের মতোই ছদ্মবেশে আদালত চত্বরে এসেছিলেন অভিযুক্ত। গুলির হামলায় রক্তাক্ত অবস্থায় আদালত চত্বরে লুটিয়ে পড়েন সঞ্জীব। পরে মৃত্যু হয় ৪৮ বছরের এই গ্যাংস্টারের।
ঘটনাচক্রে, এই হামলার দিন কয়েক আগে সঞ্জীবের প্রাণনাশের আশঙ্কা করেছিলেন তাঁর স্ত্রী পায়েল। এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। সে আশঙ্কাই সত্য হল।
সংবাদমাধ্যম ‘অমর উজালা’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশের কাছে জেরায় অভিযুক্ত স্বীকার করেছেন, সঞ্জীবকে খুন করার জন্য তাঁকে ২০ লক্ষ টাকার সুপারি দেওয়া হয়েছিল। তবে ২০ লক্ষের বদলে ৫,০০০ টাকা পেয়েছিলেন তিনি।
অভিযুক্তের দাবি, সঞ্জীবের উপর হামলার আগে আতিক আহমেদের বন্ধু আশরফের সঙ্গে নেপালে দেখা করেছিলেন তিনি। আশরফ তাঁকে খুনের সুপারি দিয়েছিলেন। আশরফের সঙ্গীরাই তাঁকে হামলার অস্ত্রশস্ত্র দেন। বিজয়ের এই বয়ান খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশের দাবি, গত ৩ দশক ধরে উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগর, শামলি, হরিদ্বার এবং ফারুকাবাদ এলাকায় খুন, অপহরণ, তোলাবাজি, ডাকাতির মতো বহু অপরাধে জড়িত ছিলেন সঞ্জীব। পুলিশের খাতায় তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত ২৪টি মামলা ঝুলছিল। তবে ১৭টিতেই বেকসুর ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন।
উত্তরপ্রদেশের অপরাধজগতে গ্যাংস্টার তথা রাজনীতিক মুন্না বজরঙ্গি ওরফে প্রেমপ্রকাশ সিংহ (বাঁ দিকে) এবং মুখতার আনসারির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সঞ্জীব।
ঘটনাচক্রে, সঞ্জীবের মতোই আদালত চত্বরে গুলির হামলায় নিহত হয়েছিলেন মুন্না। ২০১৮ সালের ৯ জুলাই বাঘপতের জেলে থাকাকালীন মুন্নার মাথায় দশটি গুলি দেগে দেন বলে জেলবন্দি গ্যাংস্টার সুনীল রাঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ।
অপরাধের পথে বেশ কম বয়সেই পা রেখেছিলেন মুজফ্ফরনগরের ওমপ্রকাশ মহেশ্বরী এবং কুন্তি মহেশ্বরীর ছেলে সঞ্জীব। তবে দাগি অপরাধীদের সঙ্গে ওঠাবসা করার আগে মধ্যবিত্তের জীবন ছিল তাঁর। রোজগারপাতির জন্য স্থানীয় এক ওষুধের দোকানের কম্পাউন্ডারি করতেন। যদিও সেখান থেকেই তাঁর অপরাধের হাতেখড়ি।
পুলিশের দাবি, যে ওষুধের দোকানে কাজ করতেন, তার মালিককেই অপহরণ করেছিলেন সঞ্জীব। সেটিই ছিল পুলিশের খাতায় তাঁর প্রথম অপরাধ। এর পর কলকাতার এক ব্যবসায়ীর ছেলেকে অপহরণ করেছিলেন বলে অভিযোগ।
নব্বইয়ের দশকে ওই অপহরণের মুক্তিপণ হিসাবে নাকি ২ কোটি টাকা দাবি করেছিলেন সঞ্জীব। এর পর হরিদ্বারের নাজিম গ্যাংয়ে নাম লেখান। পরে সে দল ছেড়ে ভিড়ে যান সত্যেন্দ্র বার্নালা গ্যাংয়ে।
দু’টি হত্যাকাণ্ড ঘিরে সঞ্জীবের কুখ্যাতি ছড়িয়েছিল। বিজেপির দুই হেভিওয়েট বিধায়ক ব্রহ্ম দত্ত দ্বিবেদী এবং কৃষ্ণনন্দ রাইয়ের খুনে নাম জড়িয়েছিল তাঁর। ১৯৯৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দ্বিবেদীর হত্যাকাণ্ডে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা হয় সঞ্জীবের।
অনেকের মতে, ১৯৯৫ সালে উত্তরপ্রদেশে রাজনৈতিক পালাবদলে অন্যতম ‘পেয়াদা’ ছিলেন ফারুকাবাদের তৎকালীন বিজেপি বিধায়ক দ্বিবেদী। রাজ্যে তখন ’৯৩ থেকে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে জোট সরকারে ছিল মায়াবতীর বিএসপি। তবে সে বছরের ২ জুন জোট ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মায়াবতী।
সে সময় ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে’র কাছে বিজেপি নেতা রাজেন্দ্র তিওয়ারির দাবি ছিল, ২ জুন লখনউয়ের একটি অতিথিশালার ১ নম্বর ঘরে ছিলেন মায়াবতী। সন্ধ্যায় সে ঘরটি ঘেরাও করেন সমাজবাদী পার্টির লোকজন। ঘরটি ভিতর থেকে তালাবন্ধ করে ফেললে বিপাকে পড়েছিলেন মায়াবতী। সে সময় তাঁকে রক্ষা করেন দ্বিবেদী। রাতে মায়াবতীকে উদ্ধার করে রাজভবনে নিয়ে যান বিজেপি নেতারা। পরের দিন বিজেপির সমর্থনে সরকার গড়ে বিএসপি। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন মায়াবতী।
যদিও ২০০৫ সালে কৃষ্ণনন্দের খুনের মামলায় বেসকুর খালাস পেয়ে যান সঞ্জীব। ২০১৯ সালে সে রায়দান করে দিল্লি হাই কোর্ট। ওই মামলায় সঞ্জীব ছাড়াও ছাড়া পেয়েছিলেন মুখতার, তাঁর ভাই আফজল আনসারি এবং আরও ছ’জন। এই মামলার শুনানি চলাকালীন রাজসাক্ষী-সহ সব প্রত্যক্ষদর্শীই নিজের বয়ান বদলে ফেলেন বলে অভিযোগ।
পুলিশের দাবি, উত্তরপ্রদেশের অপরাধজগতে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের আমদানি করার ক্ষেত্রে মুখতার আনসারি হাত রয়েছে। তবে মগজাস্ত্র খাটিয়ে সে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র কী ভাবে জোগাড় করতে হয়, তাতে পটু ছিলেন সঞ্জীব। নিজের দলে ৩৫ জনের বেশি অপরাধী ছিলেন বলেও দাবি।
উত্তরপ্রদেশ পুলিশের দাবি, গ্যাংস্টার আইনের আওতায় সঞ্জীবকে ২২ বার গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাঁর ৪ কোটির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলেও তাঁকে বাগে আনা যায়নি।
৪ সন্তানের পিতা সঞ্জীব নিজে রাজনীতির ময়দানে পা রাখেননি। তবে ২০১৭ সালে মুজফ্ফরনগর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে আরজেডির টিকিটে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী পায়েল। যদিও জয়ের মুখ দেখেননি ‘বাহুবলী’র স্ত্রী।