ফের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ? না কি আরও এক বার সরকারি ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমাতে চলেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার? চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের স্টক বিক্রির খবর প্রকাশ্যে আসতেই এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। কেন্দ্রের তরফে অবশ্য এখনও এই নিয়ে কোনও বিবৃতি মেলেনি।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কিছু শেয়ার বিক্রির পরিকল্পনা করছে কেন্দ্র। বাজার নিয়ন্ত্রণের নিয়ম মেনে চলতেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে বলে সরকারি সূত্রকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রক সূত্রে খবর, যে চারটি ব্যাঙ্কের স্টক বিক্রি করা হবে সেগুলি হল, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ় ব্যাঙ্ক, ইউকো ব্যাঙ্ক এবং পঞ্জাব ও সিন্ধ ব্যাঙ্ক। চলতি বছরের ডিসেম্বরে মোদী মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ ব্যাপারে অনুমোদন চাইতে পারেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন।
বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, বর্তমানে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের ৯৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কেন্দ্রের হাতে। ইন্ডিয়ান ওভারসিজ় ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৯৬.৪ শতাংশ। অন্য দিকে, ইউকো এবং পঞ্জাব ও সিন্ধ ব্যাঙ্কের যথাক্রমে ৯৫.৪ এবং ৯৮.৩ শতাংশ স্টকের মালিক ভারত সরকার।
সরকারি সূত্রকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানিয়েছে, অফার ফর সেলে খোলা বাজারে এই চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের স্টক বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। তবে কবে নাগাদ এতে লগ্নিকারীরা বিনিয়োগ করতে পারবেন তা স্পষ্ট নয়।
সম্প্রতি এই চারটি ব্যাঙ্কের শেয়ারের দাম তিন থেকে চার শতাংশ ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। স্টক বিক্রির খবরে এই সূচক আরও চড়বে বলেই মনে করছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। বর্তমানে ৫৬ টাকায় ঘোরাফেরা করছে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের স্টক। আর ইন্ডিয়ান ওভারসিজ় ব্যাঙ্কের শেয়ার কিনতে খরচ হবে ৫৪ টাকা।
ইউকো ব্যাঙ্কের প্রতিটা স্টকের দাম রয়েছে ৪৫ টাকা। পঞ্জাব ও সিন্ধ ব্যাঙ্কের শেয়ারে লগ্নি করতে লাগবে ৫০ টাকা। অফার ফর সেলের সময়ে এই দর কতটা বৃদ্ধি পায় সেটাই দেখার। এতে খুচরো লগ্নিকারীরা বিনিয়োগ করতে পারবেন বলেও সূত্র মারফত খবর মিলেছে।
শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিকিউরিটিজ় অ্যান্ড বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি) তালিকাভুক্ত সংস্থাগুলির ২৫ শতাংশ পাবলিক শেয়ারহোল্ডিং বজায় রাখার পক্ষপাতী। ২০২৬ সালের অগস্ট পর্যন্ত সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে এই নিয়মে ছাড় দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান।
তবে এই সময়সীমার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির পাবলিক শেয়ারহোল্ডিংয়ের পরিমাণ কতটা বাড়ানো হবে, তা স্পষ্ট করেনি রয়টার্সের সরকারি সূত্র। সেবির দেওয়া সময়সীমার মধ্যে ওই কাজ সেরে ফেলা যাবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ফের সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন যেতে পারে সেবির কাছে।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘বাজারের অবস্থার উপর ভিত্তি করে চারটি ব্যাঙ্কের শেয়ার বিক্রির সময় এবং পরিমাণ ঠিক করা হবে। এতে সব পক্ষই যাতে লাভবান হয় সে দিকে নজর রাখা হচ্ছে।’’
অতীতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির মূলধন বাড়াতে যোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক প্লেসমেন্ট (কোয়ালিফায়েড ইনস্টিটিউশনাল প্লেসমেন্ট বা কিউআইপি) চালু করে সরকার। এর ফলে এই ধরনের ব্যাঙ্কগুলির উপর কেন্দ্রের অংশীদারি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।
এ বছরের সেপ্টেম্বরে কিউআইপির মাধ্যমে বাজার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক। অন্য দিকে, অক্টোবরে ব্যাঙ্ক অফ মহারাষ্ট্রের অর্থ সংগ্রহের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।
গত জুলাইয়ে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে মিশিয়ে দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। তালিকায় নাম ছিল ইউকো ব্যাঙ্ক, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, পঞ্জাব ও সিন্ধ ব্যাঙ্ক এবং ব্যাঙ্ক অফ মহারাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে ইউকো ব্যাঙ্কের কাছে ব্যাখ্যাও চেয়েছিল বম্বে ও ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ।
ওই সময় এই নিয়ে বিবৃতি দেন ইউকো কর্তৃপক্ষ। সেখানে বলা হয়, ব্যাঙ্ক একীকরণের ভুয়ো খবর ছড়ানো হচ্ছে। এই বিষয়টি সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত। অর্থ মন্ত্রকের তরফে এই বিষয়ে কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি।
কিন্তু ওই বিবৃতি আসার পরেও ইউকো ব্যাঙ্কের শেয়ারের দর নিম্নমুখী হয়েছিল। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত অবশ্য সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির স্টকের দাম প্রায় ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত এক বছরে এতে ৯০ শতাংশের বেশি ঊর্ধ্বমুখী গতি দেখতে পাওয়া গিয়েছে।
ইউকো ব্যাঙ্ক অবশ্য এর আগে জানিয়েছিল, সিকিউরিটিজ় আইন দ্বারা নির্ধারিত ন্যূনতম পাবলিক শেয়ার হোল্ডিং নিয়ম চলার জন্য ব্যাঙ্কের বিভিন্ন স্তরে সরকারের অংশীদারি ৯৫.৪ থেকে ৭৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। আর এই কাজ আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৫) মধ্যে শেষ করবে এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক।
শেয়ার বিক্রি হলেও চারটি ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের অর্থ ও অন্যান্য বিনিয়োগ সুরক্ষিত থাকবে বলেই জানা গিয়েছে। পাশাপাশি, ঋণগ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে ইএমআই বা সুদের হারের ক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তন হবে না।
আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, স্টক বিক্রির মাধ্যমে সরকারি অংশীদারি কমলেও চারটি ব্যাঙ্কের পুরোপুরি বেসরকারিকরণ হচ্ছে, এমনটা বলা যাবে না। অন্য দিকে, পাবলিক শেয়ার হোল্ডিংয়ের পরিমাণ বাড়লে স্টকে এর লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।