বিপুল স্বর্ণভান্ডারের জ্যাকপট পেয়েছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদের সেই সোনায় নজর পড়েছে সৌদি আরবের। শুধু তা-ই নয়, মাটি খুঁড়ে ওই হলুদ ধাতুর উত্তোলনে প্রবল আগ্রহ রয়েছে আরব মুলুকের যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন আল-সৌধের। আর তাই এ ব্যাপারে সময় নষ্ট না করে শাহবাজ শরিফ সরকারের সঙ্গে একপ্রস্ত কথাবার্তা সেরে ফেলেছেন তিনি।
পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের রেকো ডিকেতে রয়েছে অন্যতম বড় তামা এবং স্বর্ণখনি। সেখানে লগ্নি করতে সৌদি প্রশাসন আগ্রহী বলে জানিয়েছে ইসলামাবাদ। আরব মুলুকটির থেকে বিনিয়োগ এলে পাক প্রশাসন যে তামা এবং হলুদ ধাতুর উত্তোলন কয়েক গুণ বৃদ্ধি করতে পারবে, তা বলাই বাহুল্য।
চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) ১৪ জানুয়ারি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াধে ‘ফিউচার মিনারেলস্ ফোরাম’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন পাক পেট্রোলিয়ামমন্ত্রী মুসাদিক মালিক। অনুষ্ঠানে ছিলেন আরব মুলুকটির যুবরাজ তথা প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ বিন সলমন। সেখানেই বালুচিস্তানের তামা ও স্বর্ণখনি নিয়ে রিয়াধের সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে বলে জানান মালিক।
অনুষ্ঠান শেষে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে পাক পেট্রোলিয়ামমন্ত্রী বলেন, ‘‘দু’পক্ষের তরফেই খনি ইস্যুতে একটা সমঝোতায় আসার চেষ্টা চলছে। খুব দ্রুত সৌদি প্রশাসনের তরফে বিনিয়োগের ঘোষণা হবে বলে আমরা আশাবাদী।’’ তবে এ ব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি রিয়াধ।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) আগামী দু’টি ত্রৈমাসিকের (জুন মাসের) মধ্যে বালুচিন্তানের রেকো ডিকোতে লগ্নি করবে সৌদি আরবের জনপ্রিয় খনি সংস্থা ‘মানারা মিনারেলস্’। এটি রিয়াধের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত খনি সংস্থা।
বালুচিস্তানের সোনা এবং তামার খনিতে বিনিয়োগের জন্য ইসলামাবাদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ) তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে সৌদি প্রশাসনের। এর মাধ্যমে মোট ৯২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার লগ্নি পেতে পারে পাকিস্তান। ভবিষ্যতে টাকার অঙ্ক আরও বাড়াবে রিয়াধ, দাবি রয়টার্সের।
বালুচিস্তানের রেকো ডিকে খনির বর্তমান মালিকানা রয়েছে পাক সরকার এবং কানাডার সংস্থা ব্যারিক গোল্ড কর্পোরেশনের হাতে। গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) মে মাসে পাক সফরে আসেন মানারা মিনারেলসের পদস্থ কর্তারা। তখন ওই খনি এলাকার ১৫ শতাংশ স্টক কেনার প্রস্তাব দেন তাঁরা। যদিও এ ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি ইসলামাবাদ।
পাক প্রশাসনের দাবি, রেকো ডিকের মাটির গভীরে এত পরিমাণ সোনা এবং তামা মজুত রয়েছে যে, আগামী ৫০ বছর ধরে উত্তোলন করলেও তা ফুরোবে না। ওই এলাকার খনি থেকে বছরে দু’লক্ষ টন তামা এবং আড়াই লক্ষ আউন্স হলুদ ধাতু আহরণ করা যাবে বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ।
১৯৯৫ সালে রেকো ডিকোর খনি থেকে তামা এবং সোনা উত্তোলন শুরু করে পাক সরকার। পাক সংবাদ সংস্থা ‘দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথম বার ওই খনি থেকে ২০০ কেজি সোনা এবং ১,৭০০ টন তামা তোলা হয়েছিল।
সূত্রের খবর, লম্বা সময় ধরে রেকো ডিকোর খনি থেকে তামা এবং সোনা উত্তোলন নিয়ে কানাডার সংস্থাটির সঙ্গে ইসলামাবাদের বিরোধ চলছে। এই অবস্থায় পাক সরকার এর শেয়ার সৌদি প্রশাসনের কাছে বিক্রি করলে পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। যদিও তাকে পাত্তা দিতে নারাজ পাক পেট্রোলিয়ামমন্ত্রী মালিক।
সম্প্রতি পাক পঞ্জাব প্রদেশে স্বর্ণভান্ডারের হদিস মিলেছে বলে ঘোষণা করেন সেখানকার সাবেক মন্ত্রী ইব্রাহিম হাসান মুরাদ। তিনি জানিয়েছেন, মাটির গভীরে লুকিয়ে আছে ২৮ লক্ষ তোলা (প্রায় ৩৩ টন) হলুদ ধাতু। পাকিস্তানি মুদ্রায় ওই সোনার বাজারমূল্য আনুমানিক ৮০ হাজার কোটি।
স্বর্ণভান্ডারের হদিস মেলার বিষয়টি এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্টের মাধ্যমে দুনিয়ার সামনে আনেন পাক পঞ্জাবের সাবেক খনিমন্ত্রী মুরাদ। সেখানে তিনি লিখেছেন, ৩২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে হলুদ ধাতুর খনি বিস্তৃত হয়ে রয়েছে। এর একটি প্রান্ত গিয়ে শেষ হয়েছে আটক এলাকায়।
প্রাক্তন মন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, স্বর্ণভান্ডারের অস্তিত্বের বিষয়টি পাক ভূতাত্ত্বিক জরিপের (জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ পাকিস্তান) বৈজ্ঞানিক রিপোর্টে উল্লেখ্য রয়েছে। পাশাপাশি, পঞ্জাব প্রদেশে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়ার সুযোগের কথাও বলেছে ওই সংস্থা।
মুরাদের দাবি, ‘‘মোট ১২৭টি এলাকা থেকে আলাদা আলাদা করে নমুনা সংগ্রহ করেন পাক ভূতাত্ত্বিক জরিপের কর্তারা। সেগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে স্বর্ণভান্ডার সংক্রান্ত রিপোর্ট তৈরি করেছেন তাঁরা। আগামী দিনে হলুদ ধাতুর উত্তোলন শুরু হলে, তা পাক অর্থনীতিতে নতুন মাইলফলক তৈরি করবে। কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে নতুন মঞ্চ পাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।’’
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) ২৯ নভেম্বর দুনিয়ার সবচেয়ে বড় হলুদ ধাতুর খনির হদিস মিলেছে বলে জানায় চিন। সেখানে লুকিয়ে থাকা সোনার পরিমাণ আনুমানিক হাজার টন বলে জানা গিয়েছে। চিনা সরকারি সংবাদমাধ্যমের দাবি, খনিতে লুকিয়ে থাকা হলুদ ধাতুর আনুমানিক বাজারদর ৮ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।
চিনের হুনান প্রদেশের পিংজিয়াং কাউন্টিতে বিশ্বের সর্বাধিক বড় স্বর্ণখনিটি অবস্থিত বলে জানা গিয়েছে। স্থানীয় ভূতাত্ত্বিক ব্যুরো জানিয়েছে, মাটির নীচে মাত্র দু’কিলোমিটার গভীরতায় ছড়িয়ে আছে ৪০টি স্বর্ণশিরা।
এত দিন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বর্ণখনির মালিক ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখানকার ‘সাউথ ডিপ’ খনিতে রয়েছে ৯০০ টন হলুদ ধাতু। নতুন স্বর্ণখনির হদিস মেলায় এ বার সেই মুকুট উঠবে বেজিংয়ের মাথায়।
বর্তমানে মারাত্মক আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। দেশটির ঋণের পরিবার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) ৪২ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। আর তাই বালুচিস্তানের খনির শেয়ার সৌদি আরবের কাছে ইসলামাবাদ বিক্রি করতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে।