অগ্নিগর্ভ ফ্রান্সের অধীনে থাকা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ নিউ ক্যালিডোনিয়া। নিরাপত্তারক্ষী এবং বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে ইতিমধ্যেই ছ’জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। তাঁদের মধ্যে এক জন পুলিশকর্মীও রয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দ্বীপরাষ্ট্রে জরুরি অবস্থা জারি করেছে প্যারিস।
সম্প্রতি নিউ ক্যালিডোনিয়ার সংসদে একটি নতুন বিল পাশ হয়েছে। সেই বিলকে কেন্দ্র করেই ঝামেলার সূত্রপাত। ক্যালিডোনিয়ার বাসিন্দাদের একাংশ এই বিল নিয়ে আপত্তি জানিয়ে পথে নেমে বিক্ষোভ শুরু করেছেন। বিক্ষোভ রুখতে তৎপর পুলিশও। শুরু হয় দু’পক্ষের সংঘর্ষ।
কী আছে নতুন বিলে? সংসদে পাশ হওয়া নতুন বিলটি ভোটাধিকার প্রয়োগ সংক্রান্ত। বিলে বলা হয়েছে, নিউ ক্যালিডোনিয়ায় যে সব ফরাসি নাগরিক ১০ বছর কিংবা তার বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন, তাঁরাই ভোটাধিকার পাবেন। এই বিষয়টি নিয়েই আপত্তি তোলেন স্থানীয়েরা।
বিক্ষোভকারীদের দাবি, তাঁরা নিউ ক্যালিডোনিয়ার পুরনো বাসিন্দা। মাত্র ১০ বছর ক্যালিডোনিয়াতে থাকলে, কেন ভোটাধিকার দেওয়া হবে? এই প্রশ্ন তুলে পথে নামেন বিক্ষোভকারীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে জরুরি বৈঠক ডাকা হয় ফ্রান্সের মন্ত্রিসভায়।
নিউ ক্যালিডোনিয়ার বাসিন্দাদের শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী গেব্রিয়াল আতাল। জরুরি ভিত্তিতে ওই দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশও দেন তিনি। গত তিন দশকে নিউ ক্যালিডোনিয়া এমন সহিংস আন্দোলন দেখেনি।
গত কয়েক দিন ধরে চলা নিউ ক্যালিডোনিয়ায় খাদ্যসঙ্কট দেখা দিয়েছে। অনাহারে বা অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন বাসিন্দারা। এই পরিস্থিতিতে নিউ ক্যালিডোনিয়ার পাশে দাঁড়াল অস্ট্রেলিয়া। কী ভাবে প্রতিবেশী দ্বীপপুঞ্জে সাহায্য করা যায় তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে অ্যান্টনি আলবানিজ় সরকার।
নিউ ক্যালিডোনিয়ার পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। দু’পক্ষের সংঘর্ষে আহত শতাধিক। চলছে ব্যাপক ধরপাকড়। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিউ ক্যালিডোনিয়ায় আন্তর্জাতিক বিমান ওঠানামার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। বুধবার ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ ওই দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন।
নিউ ক্যালিডোনিয়ায় এখনও ফরাসি শাসন চলছে। অস্টেলিয়ার পূর্বে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জের জনসংখ্যা প্রায় তিন লক্ষ। তাঁদের মধ্যে ৪৪ শতাংশই সেখানকার আদিবাসী কনক সম্প্রদায়ের মানুষ। ৩৪ শতাংশ ইউরোপীয় থাকেন সেখানে। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই ফরাসি। এ ছাড়াও ওয়ালিসিয়ান এবং তাহিতিয়ান-সহ অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাসও রয়েছে নিউ ক্যালিডোনিয়ায়। দেশের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ থাকেন রাজধানী নৌমেয়ায়।
১৮৫৩ সালে তৃতীয় নেপোলিয়ান অধিকার করেন নিউ ক্যালিডোনিয়া দ্বীপপুঞ্জ। ফরাসি শাসকেরা মূলত এই দ্বীপপুঞ্জকে জেল হিসাবে ব্যবহার করতেন। বন্দিদের জাহাজে চাপিয়ে এই দ্বীপে পাঠানো হত। কোনও ভাবেই এই দ্বীপ থেকে বন্দিদের পালিয়ে আসা সম্ভব ছিল না।
১৯৪৬ সাল থেকে নিউ ক্যালিডোনিয়ায় স্বায়ত্বশাসন স্থাপন করে ফ্রান্স। ফরাসি প্রেসিডেন্টই এই দ্বীপের প্রেসিডেন্ট। ক্যালিডোনিয়ার সংসদেও ফরাসি প্রতিনিধি রয়েছেন। প্রতিরক্ষা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে ফ্রান্সের উপর নির্ভর করে নিউ ক্যালিডোনিয়া।
১৯৫৭ সালে কনক আদিবাসীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। দেশ পরিচালনায় তাঁদেরও অংশগ্রহণ গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। তবে নিজেদের দেশে পরাধীনতা কত দিন মেনে নেওয়া যায়? কনক সম্প্রদায়ের মানুষ তাই বার বার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন।
১৯৮০-র দশক নিউ ক্যালিডোনিয়ার ফ্রান্স প্রশাসকদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কনকদের বিদ্রোহে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এই দ্বীপ। হিংসাত্মক বিদ্রোহ দমন করতে সেখানে ফরাসি সেনা পাঠানো হয়েছিল। রক্ত ঝরেছিল। প্রাণও হারিয়েছিলেন অনেকে।
যুদ্ধ শেষ করার জন্য ফরাসি কর্তৃপক্ষ নিউ ক্যালিডোনিয়াকে স্বাধীনতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। স্বাক্ষরিত হয় নৌমেয়া চুক্তি। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকা এবং চিনের মধ্যে ‘ঠান্ডা লড়াই’ ফ্রান্সকে আতঙ্কিত করে তোলে। অনেকেই আশঙ্কা করেন, স্বাধীন নিউ ক্যালিডোনিয়ায় চিন প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তাই স্বাধীনতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে ফ্রান্স।
তবে স্থানীয়দের দাবিতে নিউ ক্যালিডোনিয়ায় তিন বার ভোটাভুটি হয়। ২০১৮, ২০২০ এবং ২০২১ সালে তিনটি গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই ভোটে স্বাধীনতার পক্ষে এবং বিপক্ষে ভোটগ্রহণ হয়। কিন্তু তিন বারই গণভোটের ফল স্বাধীনতার বিপক্ষে যায়।
২০১৮ সালের গণভোটে ৪৩.৩৩ শতাংশ ভোট পড়েছিল স্বাধীনতার পক্ষে। ৫৬.৬৭ শতাংশ ছিল বিপক্ষে। ২০২০ সালে সেই সংখ্যা কিছুটা কমলেও বজায় ছিল স্বাধীনতার বিপক্ষে ভোটদানের ধারা। সে বার স্বাধীনতার বিপক্ষে ভোট পড়েছিল ৫৩.২৬ শতাংশ। ২০২১ সালের গণভোটে ৯৬.৫ শতাংশ ভোটই পড়েছিল স্বাধীনতার বিপক্ষে।
২০২১ সালে এমন চিত্র দেখা গেল কেন? যে সময় এই ভোটগ্রহণ হয় তখন বিশ্ব জুড়ে করোনার প্রভাব ছিল। করোনায় কনক সম্প্রদায়ের অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। কনক প্রথা অনুযায়ী, তাদের সম্প্রদায়ের কারও মৃত্যু হলে এক বছর ধরে শোকপালন করা হয়। সে সময় কোনও অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া প্রথাবিরোধী। তাই ২০২১ সালের গণভোট বয়কট করেন কনকেরা।
২০২১ সালের পর নৌমেয়া চুক্তির ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে। আলোচনার জন্য স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলিকে এক টেবিলে বসানোর চেষ্টা হয়েছিল অনেক বার। প্রধানত, স্বাধীনতাপন্থী এবং ফ্রান্সপন্থী— উভয়ের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে বৈঠক বানচাল হয়েছে।
স্বাধীনতার দাবিতে মাঝেমধ্যেই নিউ ক্যালিডোনিয়ায় উত্তেজনা ছড়ায়। তবে গত বৃহস্পতিবার থেকে সেখানকার পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয়। ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাকরঁ প্যারিসে জরুরি বৈঠক ডাকেন। নিউ ক্যালিডোনিয়ার রাজনীতিবিদদের চিঠিও পাঠান তিনি। শান্তি ফেরানোর জন্য আলোচনার ডাক দেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত নিউ ক্যালিডোনিয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।