আজকালকার দিনে বাচ্চা থেকে বুড়ো, সবার হাতেই নামীদামি স্মার্টফোন। আর সেই স্মার্টফোন দিয়ে নিজস্বী তোলেননি এমন লোকের দেখা মেলা ভার। নতুন মেকআপ লুক, অদ্ভুত কেশশয্যা, প্রিয় সেলিব্রিটির সঙ্গে... সবেতেই নিজস্বী। নিজস্বীর চল হালফিলের। বছর ১০-১৫ হবে। তার আগে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে পোজ দিতে দেখা যেত ছবি-পাগল মানুষদের। কিন্তু জানেন কি ভারতে প্রথম নিজস্বী কবে তোলা হয়েছিল?
যে ছবিটিকে ভারতের প্রথম নিজস্বী বলে ধরা হয়, সেটি তোলা হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীতে। তখন নিজস্বী তোলা তো দূর অস্ত্, নিজস্বী বলে ভবিষ্যতে যে কিছু থাকবে, সেই ধারণাও কারও মাথায় সম্ভবত আসেনি।
১৮৮০ সালে তোলা এই ছবিটি তুলেছিলেন মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য। ছবিটিতে দেখা যায় মহারাজা বীরচন্দ্র এবং তাঁর স্ত্রী, মহারানি খুমান চানু মনমোহিনী দেবীকে।
ভারতের এই প্রথম নিজস্বীতে রাজা বীরচন্দ্র এবং রানি খুমান চানুকে ঘনিষ্ঠ ভাবে আলিঙ্গন করে বসে থাকতে দেখা যায়।
এই ছবি ভাল করে দেখলে দেখা যাবে, রাজা বীরচন্দ্র নিজের বাঁ হাতে কিছু একটা চেপে ধরে আছেন। দেখে মনে হবে ছোট কোনও যন্ত্র।
বীরচন্দ্র হাতে যে যন্ত্রটি ধরে আছেন সেটি আসলে ক্যামেরার সঙ্গে একটি লম্বা তার দিয়ে যুক্ত। ওই যন্ত্রটি টানলেই ব্যস! তোলা হয়ে যাবে আপনার ছবি।
এই ভাবেই রাজা-রানি নিজেদের বিশেষ মুহূর্তটিকে নিজস্বী-রূপে বন্দি করে রেখেছিলেন।
বীরচন্দ্রের এই আবিষ্কার প্রশংসনীয় হলেও প্রশ্ন থেকে যায় তিনি কী ভাবে এই পদ্ধতি ভেবেছিলেন? কারণ, যে যুগের কথা হচ্ছে তখন ক্যামেরা থাকাই ছিল বিলাসিতার ব্যাপার। ক্যামেরার বিষয়ে কোনও সম্যক ধারণাও কারও ছিল না।
কিন্তু বীরচন্দ্রের ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা ছিল। তৎকালীন সময়েও বীরচন্দ্রের কাছে ছবি তোলার সমস্ত সরঞ্জাম ছিল। একই সঙ্গে ছবির কাজ করার জন্য তাঁর রাজপ্রাসাদে ‘ডার্ক রুম’-ও ছিল।
মহারাজা বীরচন্দ্রই ভারতে প্রথম ‘ড্যাগেরোটাইপ (একটি রূপালী প্লেট এবং পারদ বাষ্প দিয়ে ছবি তোলার পদ্ধতি)’ ফটোগ্রাফির প্রবর্তন করেন।
ক্যামেরা-প্রীতি থেকে বীরচন্দ্র আগরতলার রাজপ্রাসাদে একটি ক্যামেরা ক্লাবও তৈরি করেছিলেন।
বীরচন্দ্রের তোলা নিজস্বী থেকে তিনি পরে একটি ছবিও আঁকেন। ত্রিপুরার বহু চিত্র প্রদর্শনীতে এখনও এই ছবি মাঝে মধ্যেই দেখানো হয়।
বীরচন্দ্র এবং খুমান চানু, উভয়েই শিল্প-অনুরাগী ছিলেন। তবে যে শিল্পের প্রতি সব থেকে বেশি আকর্ষণ ছিল, তা হল ফটোগ্রাফি।
ভারতে বীরচন্দ্রই ছিলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি তথা রাজ পরিবারের সদস্য যাঁর কাছে ক্যামেরা ছিল। প্রথম ব্যক্তি ছিলেন ইনদওরের রাজা দীনদয়াল।
ছবি তোলার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ থাকলেও বীরচন্দ্র এক জন উঁচু দরের স্থপতিও ছিলেন। আধুনিক আগরতলার পরিকল্পনার কৃতিত্বও তাঁকেই দেওয়া হয়।
বীরচন্দ্র এক জন চিন্তাশীল এবং দূরদর্শী রাজা ছিলেন। ত্রিপুরার মানুষদের মধ্যে উন্নতমানের চিন্তাধারার বীজ বপন করতেও তিনি উদ্যত হয়েছিলেন।
সংবাদমাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে প্রয়াত মহারাজার বংশধর এম কে প্রজ্ঞা দেব বর্মণ বলেন, “তিনি শিল্পকলা এবং ছবি তোলার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন। তাঁর অর্ধাঙ্গিনীও ছিলেন একইরকম শিল্পানুরাগী৷ এই জুটি শিল্পের সঙ্গে ত্রিপুরার ইতিহাসের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন।’’