এক-একটি ছবি যে হাজারো কথা বলতে পারে, তেমনটা তো অনেকেই শুনেছি। তবে তেমন ছবির মধ্যেও বেশ কয়েকটি অলক্ষেই রয়ে যায়। ইতিহাসের পাতায় ছাপ ফেলা এমনই কয়েকটি ছবিতে ধরা পড়েছে বহু স্মরণীয় মুহূর্ত। ফিরে দেখা যাক তারই কয়েকটি।
ষাটের দশকের বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এক নিঃশব্দ প্রতিবাদ ফুটে উঠেছিল আমেরিকার টেলিভিশনে। ‘মিস্টার রজার্স’স নেইবারহুড’ নামে তখনকার এক জনপ্রিয় ধারাবাহিকে দেখা গিয়েছিল, প্রতিবেশী অফিসার ফ্রাসোয়াঁ ক্লেমঁসকে নিজের বাড়িতে ডেকেছেন রজার্স। বাড়ির পিছনে একই গামলার জলে পা ডুবিয়ে বসে রয়েছেন দু’জনে। অ-শ্বেতাঙ্গ রজার্সের পাশে বসেছিলেন এক শ্বেতাঙ্গ অফিসার। আজও এ ছবিতে বর্ণবৈষম্য বিরোধীদের জোরালো কণ্ঠ শোনা যায়।
নাৎসিরা তাঁর জীবন কেড়ে নিয়েছিলেন। তবে জীবনের শেষ মুহূর্তেও নিজের সঙ্গীদের সঙ্গে বেইমানি করেননি ১৭ বছরের কিশোরী। তাঁদের নাম বলতে অস্বীকার করেন। ১৯৪৩ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৭ বছরের লিপা র্যাডিচকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন নাৎসি সেনারা। ‘‘তোমার সঙ্গীদের নাম কী?’’ সে সময় প্রশ্ন করেছিলেন নাৎসিরা। তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার নাগরিক তথা প্যারিসের বাসিন্দা ওই কিশোরীর সপাট জবাব ছিল, ‘‘যখন তাঁরা আমার (খুনের) প্রতিশোধ নিতে আসবে, তখন জানতে পারবে।’’
আয়নার সামনে বড়সড় ক্যামেরায় হাত দিয়ে বসে স্বামী। তাঁকে আলগোছে জড়িয়ে ধরেছেন পিছনে দাঁড়ানো স্ত্রী। তাঁর বাঁ-হাতে ধরা স্বামীর মুঠোয়। এ বার ক্যামেরার ‘ক্লিক’ করে নিজস্বী তোলার পালা। ১০০ বছরের বেশি আগে জাপানি দম্পতির এই নিজস্বী আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। যদিও সেটিই প্রথম নিজস্বী নয়। দাবি করা হয় যে, ১৮৮৯ সালে রবার্ট কর্নেলিয়াসের ছবিটিই প্রথম নিজস্বী।
রবের্টা লুইস গিব ওরফে ববিকে অনেকেই হয়তো ভুলে গিয়েছেন। তবে ১৯৬৬ সালে তিনি বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিলেন বস্টনের রাস্তায়। বস্টন ম্যারাথনে সে সময় মহিলাদের অংশ নেওয়ার অধিকার ছিল না। ববিই প্রথম মহিলা যিনি ওই ম্যারাথনে অংশ নেন। আয়োজকদের থেকে প্রতিযোগীর নম্বর পাননি তিনি। সেটি ছাড়াই দৌড়ে গোটা ম্যারাথন শেষ করেন ববি।
অস্কার মনোনয়ন জেতা অভিনেত্রী সিগরনি উইভারের হাইস্কুলের ছবিও কম অর্থবহ নয়। কমবয়সি সুজান আলেকজান্দ্রা তখনও সিগরনি বলে পরিচিত নন। সে সময় থেকে সমাজের রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী তিনি। হাইস্কুলের ইয়ারবুকে তাঁর ছবির পাশে লিখেছিলেন, ‘প্লিজ গড, প্লিজ, আমাকে স্বাভাবিক হতে দিয়ো না।’
ফ্রিকশন হিটারের আবিষ্কর্তা চার্লস এসএল বেকারের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর সহকারী (বাঁ-দিকে)। রেডিয়েটর সিস্টেম কী ভাবে কাজ করে, তা দেখাচ্ছেন দু’জনে। কৃষ্ণাঙ্গ এই আবিষ্কারকের জন্যই আমেরিকার ঘরে ঘরে হিটার পৌঁছেছিল। শীতে আরাম পেয়েছিলেন সে দেশের বহু বাসিন্দা।
যুদ্ধের বীভৎসতার মধ্যেও কর্তব্যচ্যুতি ঘটত না লন্ডনের দুধ সরবরাহকারীদের। ১৯৪০-’৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মানদের বোমাবর্ষণে লন্ডন শহরের ধ্বংসপ্রায় দশার মধ্যেও নিজেদের কাজ করে গিয়েছেন তাঁরা।
লাতিন কোয়ার্টার নাইটক্লাবের পর্দার আড়ালে কী হত? কৌতূহল ছিল অনেকেরই। তবে সে ছবি চমকে দেওয়ার মতো। গ্রাহক মনোরঞ্জনের ফাঁকে ব্যাকস্টেজে দাবা খেলতে বসতেন বহু ‘শোগার্ল’। এ ছবি ১৯৫৮ সালের।
ইস্টারের সময় হিটলারের জন্য নিজেদের হাতে ‘ভালবাসার’ উপহার তৈরি করেছিলেন দুই অ-শেতাঙ্গ আমেরিকান সেনা। ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেই ‘উপহার’ (ইনফ্যান্ট্রি শেল) নিয়ে ছবিও তুলেছিলেন তাঁরা। ‘উপহারের’ গায়ে লেখা— ‘হিটলারের জন্য ইস্টারের ডিম’।
এ বারের ছবিতে প্রতিবাদী ডেভিড ইলম। ১৯৫৮ সালের ৮ জুন ফ্লরিডার এক সুইমিং পুলের জলের পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন তিনি। যে সুইমিং পুলে কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গদেরই প্রবেশাধিকার ছিল। ইলম তাতে ঢোকার পরই সুইমিং পুলটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। কারণ, তা ব্যবহার করেছেন এক অ-শ্বেতাঙ্গ।
ষাটের দশকে বহু তোলপাড় করা রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্থান দেখেছে আমেরিকা। ঘরের অন্দরে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া বয়েছে। গৃহযুদ্ধের আবহে বিপ্লব ঘটেছে সমাজের নানা স্তরে— উডস্টক, স্টোনওয়াল দাঙ্গা থেকে শুরু করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যাকাণ্ড। ঘরের বাইরে ভিয়েতনাম যুদ্ধের আঁচও লেগেছে সে দেশের গায়ে। এরই মাঝে দেশের নাগরিকদের সুখী সংসার ফুটে উঠেছে ১৯৫৯ সালে এই ছবিতে।
নামজাদা স্টুডিয়োগুলি এক সময় জাঁকিয়ে বসেছিল হলিউডে। তারই মধ্যে একটি ছিল মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার (এমজিএম)। এমজিএমের ছবি শুরুর আগে তাদের লোগোয় থাকা সিংহের গর্জনে কেঁপে উঠত সিনেমহলগুলি। ১৯২৮ সালে তাঁর লোগোর শ্যুটিংয়ে আনা হয়েছিল পেল্লাই আকারের এক সিংহ।
সাংবাদিক, অনুবাদক তথা মার্ক্সবাদী মারিনা গিনেস্তের সরব মুখ ভেসে উঠেছিল স্পেনীয় গৃহযুদ্ধের সময়। ওই সময়ই বার্সেলোনার একটি হোটেলের ছাদে দাঁড়ানো মারিনার একটি ছবি আজও ভোলেননি অনেকে। ১৯৩৬ সালের ২১ জুলাই হুয়ান গাজম্যানের তোলা ওই ছবিতে ১৭ বছরের কিশোরী মারিনা উর্দিধারী। পিঠে তখন বয়ে বেড়াচ্ছেন সশস্ত্র বিপ্লবের অস্ত্র।
ছোটবেলায় প্রথম বার সাইকেল চালানোর দিনগুলির কথা মনে পড়ে? সে সব স্মৃতি বোধ হয় একসঙ্গে জড়ো করে ফেলেছে এই ছবিটি। সাইকেলের উপর বসে প্রাণপণে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টার মাঝে পিছনে ধরা বাবার শক্ত হাত... ।
সাতসকালে প্রিয় পোষ্যকে সঙ্গে করে ছুটতে ছুটতে বেকারির দরজায় পৌঁছে গিয়েছে ছোট্ট মেয়েটি। তবে বেকারির মালিক তখনই বোর্ড ঝুলিয়ে দিচ্ছেন— আজ আর কুকুরের জন্য বিস্কুট পাওয়া যাবে না। শীতের সকালে তখনও আশায় আশায় দাঁড়িয়ে ছোট্ট মেয়েটি আর তাঁর প্রিয় পোষ্য। লন্ডনের রাস্তায় ১৯৩৯ সালে তোলা হয়েছিল এ ছবি।
গাঁজা চাষ করার অভিযোগে হাতেনাতে ধরা পড়েছেন পুলিশের হাতে। তবে তাতেও ক্লেশ নেই চোখেমুখে। সত্তরের দশকে আমেরিকায় তোলা এই ছবি।
এলভিস প্রেসলির অনুষ্ঠানে তাঁর অনুরাগীরা কী রকম আচরণ করতেন? তার ঝলক মেলে এই ছবিতে। ১৯৫৭ সালের ৬ এপ্রিল ফিলাডেলফিয়া এরিনার মঞ্চ মাতিয়েছিলেন এলভিস। সে সময় প্রিয় গায়কের সঙ্গে সজোরে কণ্ঠ ছেড়েছিলেন তাঁর কিশোরী ভক্ত।