বিশ্বকাপের শুরুটা ভাল হয়নি, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্জেন্টিনা ফিরেছে ছন্দে। গ্রুপ পর্যায় পেরিয়ে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালেও জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন মেসিরা।
প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে দিয়েছে আর্জেন্টিনা। দু’টি গোলের মধ্যে একটি স্বয়ং মেসির। ম্যাচের ৩৪ মিনিটের মাথায় তাঁর গোল খেলায় প্রাণ ফিরিয়ে আনে।
অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আরও একটি গোল করেছেন জুলিয়ান আলভারেজ। ম্যাচের ৫৭ মিনিটের মাথায় সেই গোল আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেয় ২-০।
এর পর একটি গোল শোধ করতে পেরেছিল ক্যাঙারুদের দেশ। তবে তা-ও আত্মঘাতী গোল। ৭৭ মিনিটে আর্জেন্টিনার গোলপোস্টের দিকে উড়ে আসা একটি বলে মাথা ছুঁইয়ে ফেলেন এনজ়ো ফার্নান্ডেজ। খেলার ফল হয় ২-১।
অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দুরন্ত এই জয়ের পর হাসতে হাসতে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে চলে গিয়েছেন মেসিরা। নীল-সাদা জার্সির এই জয় অগণিত ভক্তের মতো স্টেডিয়ামে বসে দেখলেন আরও এক জন। তিনি আর্জেন্টিনার বর্ষীয়ান এবং বিশ্বকাপের অন্যতম প্রবীণ সাংবাদিক।
কথা হচ্ছে এনরিক মাকায়া মারকুয়েজকে নিয়ে। কাতার বিশ্বকাপ সূচনার দিন নিজের ৮৮তম জন্মদিন পালন করেছেন এই আর্জেন্টিনীয় সাংবাদিক।
ফিফার হিসাব অনুযায়ী, কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপ কভার করতে যাওয়া সাংবাদিকদের মধ্যে বর্ষীয়ান তিনিই। মোট ১৭টি বিশ্বকাপে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন।
বিশ্বকাপে সাংবাদিক হিসাবে মারকুয়েজের অভিষেক হয় ১৯৫৮ সালে। যে বিশ্বকাপে মাত্র ১৭ বছর বয়সে অভিষেক হয়েছিল ব্রাজিলীয় কিংবদন্তি পেলের।
সেই ১৯৫৮ থেকে ২০২২। দীর্ঘ ৬৪ বছর ধরে বিশ্বকাপ দেখছেন মারকুয়েজ। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এমন রেকর্ড আর কারও নেই। তাঁকে এবং তাঁর মতো আরও কয়েক জন বর্ষীয়ান সাংবাদিককে এ বছর বিশেষ সম্মান দিয়েছে ফিফা।
মারকুয়েজ ছাড়াও সাংবাদিক হিসাবে অনেক বিশ্বকাপ কভার করার রেকর্ড রয়েছে জার্মানির হার্টমুট শেরজা (১৬টি বিশ্বকাপ) এবং উরুগুয়ের জর্জ দা সিলভেইরার (১৫টি বিশ্বকাপ)।
এ ছাড়া, অন্তত ৮টি বিশ্বকাপে সংবাদমাধ্যমের হয়ে কাজ করেছেন, এমন ৮২ সাংবাদিককে সম্প্রতি কাতারের রাজধানী দোহাতে বিশেষ সম্মান প্রদান করেছে ফিফা। ফিফার সঙ্গে সেই অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজক ছিল ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (এআইপিএস)।
দোহার সেই অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জার্নালিস্টস অন দ্য পোডিয়াম’। সেখানে মারকুয়েজ ও অন্যান্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ফুটবল বিশ্বকাপের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। ব্রাজিলের কিংবদন্তি তারকা রোনাল্ডো নাজারিওর হাত থেকে পুরস্কার নেন মারকুয়েজ।
১৯৫৮ সালে মারকুয়েজ যখন জীবনের প্রথম বিশ্বকাপটি কভার করতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি ২৩ বছরের তরুণ। উৎসাহ আর উত্তেজনায় যেন সর্বক্ষণ ফুটছেন। ফিফার সম্মান প্রদান অনুষ্ঠানে সেই স্মৃতিচারণ করেছেন মারকুয়েজ।
সে সময় একটি আর্জেন্টিনীয় রেডিয়ো চ্যানেলে ধারাভাষ্যকার হিসাবে কাজ করতেন মারকুয়েজ। সুইডেনে আয়োজিত বিশ্বকাপের সব খবরাখবর দেশে পাঠাতেন টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে।
রেডিয়ো ছেড়ে মাঝে মারকুয়েজ টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তার পর আবার ফিরেছেন বেতারে। বর্তমানে তিনি ডি স্পোর্টস-এ কাজ করেন।
আটান্নর সেই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে রীতিমতো পর্যুদস্ত করেছিল চেকোস্লোভাকিয়া। আপাত অনামী এই দেশের কাছে তারকাখচিত আর্জেন্টিনাকে ৬ গোল হজম করতে হয়েছিল।
সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে মারকুয়েজ বলেন, ‘‘বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে আমরা নিজেদের বিশ্বসেরা বলে মনে করতাম। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, যে দেশের নামই কখনও শুনিনি, তারা আমাদের ৬ গোল দিল! হজম করতে পারছিলাম না।’’
সময় পেরিয়েছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে গিয়েছে বিশ্বকাপ। ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এই মঞ্চে একসময় লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার নিয়মটুকুও ছিল না। সাক্ষী মারকুয়েজ।
১৯৮৬ সালে মারাদোনার ‘হ্যান্ড অফ গড’ বিতর্কের ঝড় তোলে। বিশ্বকাপের সেই আদি লগ্ন থেকে ফিফার বিবর্তন দেখেছেন মারকুয়েজ। কাতারের বিশ্বকাপে এক-একটি গোল নিয়ে প্রযুক্তির চুলচেরা বিশ্লেষণ তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিকে আরও সমৃদ্ধ করল।
মারকুয়েজরা জানান, ফুটবল এখন অনেক বেশি জনপ্রিয়। পাঁচ কিংবা ছয়ের দশকে ফিফার বিশ্বকাপ নিয়ে যে উন্মাদনা, ২০২২-এর সঙ্গে তার আকাশপাতাল তফাত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে সংবাদমাধ্যমও। মারকুয়েজ জানান, আগের চেয়ে এখন বিশ্বকাপে সাংবাদিকদের সংখ্যাও অনেক বেশি হয়েছে।
বিশ্বকাপের টুকরো স্মৃতির কোলাজ এবং অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে ফিফার পুরস্কারমঞ্চে উঠেছিলেন মারকুয়েজরা। যত দিন বিশ্বকাপ থাকবে, ফিফার সঙ্গে থেকে যাবে তাঁদের এই সঞ্চয়ও।