পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তা সত্যি হতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে গিয়েছে বেশ খানিকটা। যা যুদ্ধেরই প্রভাব বলে মনে করা হচ্ছে।
ইজ়রায়েলের উপর প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হামলার পরেই যুদ্ধের দামামা বেজেছে পশ্চিম এশিয়ায়। ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ ঘোষণা করে পাল্টা প্রত্যাঘাত করেছেন হামাসের উপর।
বৃহস্পতিবার সেই যুদ্ধ ১৯ দিনে পা দিল। ইতিমধ্যে মৃত্যুমিছিল দেখে ফেলেছে ভূমধ্যসাগর। শুধু গাজ়াতেই মৃতের সংখ্যা ছ’হাজার পেরিয়েছে। আহত ১৬ হাজার ছাড়িয়েছে।
পশ্চিম এশিয়ার এই যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে চলেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। যা থেকে বাদ যাবে না ভারতও। কারণ সারা বিশ্বে অপরিশোধিত তেলের অন্যতম প্রধান জোগানদার এশিয়ার পশ্চিম অংশ।
যুদ্ধের ফলে পশ্চিম এশিয়া থেকে তেলের জোগান কমবে, আগেভাগেই তা আঁচ করেছিলেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। ফলে তেলের দাম যে বৃদ্ধি পেতে পারে, তা অনুমেয়।
গত ১৯ দিনে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমেরিকার সরকারি ঋণপত্রও পাঁচ শতাংশের গণ্ডি ছাড়িয়েছে, যা গত ১৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ। অপরিশোধিত তেলের একটা বড় অংশ প্রতি বছর ভারত আমদানি করে। ফলে তেলের দাম বৃদ্ধি ভারতের মাথাব্যথার কারণ।
আমদানি করা তেলের উপরেই ভারত নির্ভর করে থাকে। তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও পাল্লা দিয়ে বাড়বে। মূল্যবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিতে পারে।
পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, ইজ়রায়েল-হামাসের এই যুদ্ধে যদি সরাসরি ইরান যোগদান করে, তবে তেলের দাম হু-হু করে বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে তা চাপ সৃষ্টি করবে।
বিশ্বের অন্যতম বড় দুই তেল উৎপাদক দেশ সৌদি আরব এবং রাশিয়া। তারা তেলের জোগান কমিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। দুই দেশ থেকে প্রতি দিন প্রায় ১৩ লক্ষ ব্যারেল করে তেলের জোগান কমে যাবে নতুন বছর শুরুর আগেই।
এই মুহূর্তে বিশ্বের বাজারে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৯০ ডলার। রাশিয়া, সৌদির ঘোষণার পর এমনিতেই তেলের বাজারে চাপ তৈরি হয়েছে। ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধে সেই চাপ আরও বাড়তে পারে।
তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামে তার প্রভাব অনিবার্য। এর ফলে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে। সুদের হার বাড়িয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের আর উপায় নেই। সার্বিক ভাবে যা বিশ্ব অর্থনীতির গতি শ্লথ করে দিচ্ছে।
ভারত যে হেতু আমদানিকৃত তেলের উপরেই নির্ভরশীল, তাই তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পেলে সার্বিক ভাবে ভারতের আমদানির খরচও বাড়তে শুরু করবে।
তেলের আমদানিতে বেশি খরচ হয়ে গেলে তার প্রভাব পড়বে ভারতের বাণিজ্যে। কারণ এক দিকে খরচ বেড়ে গেলে অন্য দিকে খরচ কমতে বাধ্য। অন্য পণ্যের বাণিজ্যও সে ক্ষেত্রে ব্যাহত হবে।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ১০ ডলার করে বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ ভারতের মূলধন ঘাটতি ০.৫ শতাংশ করে বৃদ্ধি পাওয়া।
তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে আমেরিকান ডলারের মূল্য আরও বাড়বে। যা ভারতীয় টাকার পক্ষে সুলক্ষণ নয়। কারণ ভারত বিদেশ থেকে তেল কেনে ডলারের মাধ্যমেই। বেশি ডলার খরচ করতে হলে ডলারের চাহিদা বাড়বে, টাকার দাম কমবে।
তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে তার প্রভাব পড়তে পারে ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাতেও। রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে সুদ বৃদ্ধি করতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সার্বিক ভাবে মুদ্রাস্ফীতির দিকে এগিয়ে যাবে দেশ।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে তার প্রভাব যাতে সরাসরি অভ্যন্তরীণ বাজারে না পড়ে, তার জন্য সরকার থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয়। তেলের দাম বাড়তে থাকলে সেই ভর্তুকিও বৃদ্ধি করতে হবে সরকারকে। তা যদি করা হয়, তবে সরকারের রাজস্বে টান পড়তে পারে।
এশিয়ায় ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক সঙ্গী ইজ়রায়েল। বিশ্বের নিরিখে দশম স্থানে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি। জল, ওষুধপত্র, টেলিকম, তথ্যপ্রযুক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে লেনদেন চলে।
ইজ়রায়েল থেকে ভারতে আমদানি করা প্রধান পণ্য অপরিশোধিত তেল। এ ছাড়াও মুক্তো-সহ একাধিক দামি পাথর, রাসায়নিক এবং খনিজ পদার্থ, কৃষিকাজের উপযোগী বিভিন্ন উপাদান, যন্ত্রপাতি ভারত ইজ়রায়েলের কাছ থেকে কেনে। যুদ্ধের ফলে এই বাণিজ্যেও প্রভাব পড়ছে। দেশের অর্থনীতিবিদেরা যাতে সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছেন।