পর পর দুই ত্রৈমাসিকে আমেরিকার জিডিপিতে উদ্বেগজনক ভাবে পতন দেখা দিয়েছে। এর আগে অতিমারি আবহে অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল আমেরিকা। পরে সেই দেশের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, তারা সেই মন্দা কাটিয়ে উঠেছে। তবে এই বার পর পর দুই ত্রৈমাসিকে জিডিপির পতনের ফলে একটাই প্রশ্ন বার বার উঠে আসছে। তা হলে কি আবারও অর্থনৈতিক মন্দার পথে রয়েছে বিশ্বের এই উন্নত দেশ?
প্রযুক্তিগত ভাবে কর্মসংস্থান, ভোক্তা ব্যয়, ব্যক্তিগত আয় এবং উৎপাদনের মাপকাঠি পর্যবেক্ষণ করে বিশেষজ্ঞদের একটি দল জানাচ্ছে শীঘ্রই অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হতে চলেছে আমেরিকা। একই সঙ্গে বিগত চার দশকের তুলনায় বর্তমানে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকায় আমেরিকার অনেক বাসিন্দাও মনে করছেন যে, ইতিমধ্যেই মন্দা দেখা দিয়েছে সে দেশে।
কী দেখে এই সিদ্ধান্তে এলেন বিশেষজ্ঞরা?
ফেডারেল রিজার্ভের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অ্যালান গ্রিনস্প্যানের তত্ত্ব অনুযায়ী, আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা আসবে কি না, তা বোঝা যায় সে দেশের পুরুষদের অর্ন্তবাস কেনার অভ্যাস দেখে। অ্যালানের মতে সে দেশের পুরুষেরা যদি হঠাৎ করে অর্ন্তবাস কেনা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমিয়ে দেন বা বন্ধ করে দেন তা হলে জানতে হবে যে, সে দেশে শীঘ্রই মন্দা আসতে চলেছে।
অ্যালান জানিয়েছেন, আমেরিকার পুরুষদের মধ্যে নতুন নতুন অন্তর্বাস কেনার ঝোঁক রয়েছে। বিশেষ কিছু ব্র্যান্ডের অন্তর্বাসের প্রতি রয়েছে তাঁদের বেশি দুর্বলতা। তবে সমীক্ষা অনুযায়ী, বিগত কয়েক মাসে সে দেশের পুরুষদের অর্ন্তবাস কেনার সংখ্যা অনেক কমেছে। আর তা দেখেই মন্দা আসার আশঙ্কা করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
আমেরিকায় ২০০৮ এবং ২০২০ সালের আর্থিক সঙ্কটের সময়ও এই লক্ষণ দেখা গিয়েছিল বলেও তাঁর মত।
আমেরিকার জনপ্রিয় পানীয়গুলির মধ্যে অন্যতম হল শ্যাম্পেন। আমেরিকার বাসিন্দারা যে কোনও আনন্দ শ্যাম্পেনের বোতল খুলে উদ্যাপন করতে পছন্দ করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্যাম্পেন বিক্রি দেখেও বোঝা যায় যে, আমেরিকায় মন্দা আসতে পারে কি না।
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট জুড়ে শ্যাম্পেনের বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল। ১৯৮৭ সালে সারা বছর ধরে ১ কোটি ৫৮ লক্ষ বোতল শ্যাম্পেন বিক্রি হয়েছিল। এর পরই ১৯৯২ সালে অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে শ্যাম্পেনের বিক্রি বেশ খানিকটা কমে যায়। এই একই জিনিস বার বার ঘটেছে।
২০০৬ সালেও শ্যাম্পেনের বোতলের বিক্রি অনেক বেড়ে যায়। তবে ২০০৯ সালে বোতলের বিক্রি প্রায় এক কোটি কমে যায়। শ্যাম্পেনের বোতল বিক্রি কমে যায় ২০১২ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও।
২০০০ সালে আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দার সময় প্রসাধন সংস্থা এস্টি লওডার প্রথম ‘দ্য লিপস্টিক এফেক্ট’ শব্দটি ব্যবহার করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়ে সে দেশের মহিলাদের মধ্যে লিপস্টিক কেনার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক মন্দার মুখে আমেরিকার মহিলারা দামি দামি প্রসাধন সামগ্রী কেনা বন্ধ করে দিলেও লিপস্টিক কেনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। যদিও ২০০৮ সালের মন্দার সময়ে এই যুক্তির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দেখা যায়, এই মন্দার সময়ে লিপস্টিকের বিক্রি তিন শতাংশ অবধি কমে গিয়েছিল।
কেউ কেউ এ-ও বিশ্বাস করেন যে, আমেরিকায় বাবা-মায়েরা সন্তানদের ডায়পার কম পরিবর্তন করলে বুঝে যেতে হবে যে, সেই দেশ আর্থিক মন্দার মুখে রয়েছে। আমেরিকায় বাবা-মায়েরা সাধারণত খুব ঘন ঘন বাচ্চাদের ডায়পার বদল করেন। কিন্তু এই ভাবে তাঁরা টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করলে বুঝতে হবে, পরিবারগুলির আয় কমেছে এবং খুব শীঘ্রই দেশে অর্থনৈতিক সঙ্কট আসতে চলেছে।
১৯২৯ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত চরম আর্থিক মন্দার মুখে পড়ে আমেরিকা। আর তখন থেকেই মন্দার সঙ্গে মেয়েদের স্কার্টের মাপের সম্পর্ক তৈরি করতে ব্যস্ত সে দেশের একাংশ। আমেরিকার বাসিন্দাদের একাংশের মতে সে দেশের অর্থনীতি আকাশ ছুঁলে মেয়েদের স্কার্টের দৈর্ঘ্য ছোট হয়। অন্য দিকে আর্থিক মন্দার মুখে পড়লে সে দেশের মহিলারা নাকি তুলনামূলক ভাবে বেশি দীর্ঘ স্কার্ট পরেন।
অতি সম্প্রতি, করোনা আবহে তৈরি হওয়া আর্থিক সঙ্কটেও মহিলাদের স্কার্টের দৈর্ঘ্যে এই তারতম্য লক্ষ করা গিয়েছে।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে আমেরিকার অর্থনীতিবিদরা আর্থিক মন্দা আসছে কি না তা বোঝার জন্য একটি নতুন মাপকাঠি খুঁজে বার করেন। আমেরিকার অর্থনীতিবিদদের একাংশের মতে দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে অর্থনৈতিক মন্দার খবরের সংখ্যা যদি অনেক বেশি হয়, তা হলে ধরে নিতে হবে যে, খুব শীঘ্রই অর্থনৈতিক মন্দা কড়া নাড়তে চলেছে। ১৯৯০, ২০০১ এবং ২০০৭ সালেও এর অন্যথা হয়নি।
কার্ডবোর্ড-বাক্সের সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধিকেও অর্থনৈতিক সূচক বলেই মনে করেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ। যদি আমেরিকায় কার্ডবোর্ড-বাক্সের চাহিদা কমে তা হলে ধরে নিতে হবে যে, সেই দেশ অর্থনৈতিক মন্দার মুখে ইতিমধ্যেই পড়েছে বা পড়তে চলেছে।
এ ছাড়াও আমেরিকায় কত মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন তার উপরেও নির্ভর করে সে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোন জায়গায় রয়েছে। যদি আমেরিকায় খুব বেশি সংখ্যক মানুষ খুব কম সময়ের ব্যবধানে চাকরি হারান, তা হলে ধরে নিতে হবে সে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পতন দেখা দিয়েছে। এমনটাই মত সে দেশের বিশেষজ্ঞদের।