বেকারত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে— এমন আশা নিয়ে প্রতি বছর বিশ্বের পিছিয়ে পড়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি থেকে আমেরিকা এবং ইউরোপের উদ্দেশে পাড়ি দেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। ভারত থেকেও বহু মানুষ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ান।
এই ভাবে ঝুঁকি নিয়ে, অনুমোদনহীন তৃতীয় পক্ষের সাহায্য নিয়ে অবৈধ উপায়ে অন্য দেশে ঢোকার যে সফর, তাকেই বলা হয় ‘ডাঙ্কি’। বাস্তবের এই কাহিনিকেই সিনেমার পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন চিত্রপরিচালক রাজকুমার হিরানি।
শাহরুখ সেলুলয়েডে যে গল্প বলেন, বাস্তবে জগদীশ পটেলের গল্পও যেন তার সঙ্গে খানিক মিলে যায়। কী হয়েছিল জগদীশের, যার জন্য এখনও তাঁর নাম নিয়ে নিরন্তর চর্চা চলে?
জগদীশের অন্য দেশে যাওয়ার নেপথ্যকাহিনি জানতে হলে ফিরতে হবে তাঁর গ্রাম দিনগুচায়। গুজরাতের রাজধানী গান্ধীনগর থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামে বাস করতেন প্রায় ৩০০ জন মানুষ।
কিন্তু বেকারত্ব ছিল নিত্যসঙ্গী। সুদিনের সন্ধানে গ্রামবাসীরা একে একে অন্যত্র কাজ জুটিয়ে চলে যেতে থাকেন। সেই সময় হঠাৎই ওই গ্রামে বেশ কিছু পোস্টার পড়ে।
পোস্টারগুলিতে লেখা থাকত, “আমেরিকা-কানাডায় পড়তে যেতে চান? মাত্র তিন দিনে মিলবে সুযোগ। যোগাযোগ করুন এই নম্বরে।” আমেরিকায় কাজ জুটিয়ে দিনবদলের স্বপ্ন দেখা গ্রামবাসীরা ওই নম্বরগুলিতে ফোন করে যোগাযোগ করতেন এজেন্টদের সঙ্গে।
এই গ্রামবাসীদেরই এক জন ছিলেন জগদীশ। এক সময় শিক্ষকতাকেই পেশা হিসাবে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। শেষে ৬৫ লক্ষ টাকা খরচ করে ৩৯ বছরের জগদীশ ডাঙ্কি এজেন্টদের শরণাপন্ন হন।
এজেন্টদের ব্যবস্থাপনায় স্ত্রী এবং দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে দেশ ছাড়েন জগদীশ। ঘুরপথে এবং অবৈধ উপায়ে আমেরিকায় ঢুকতে এজেন্টের পরামর্শমতো পৌঁছন কানাডার টরন্টোয়।
কিন্তু আমেরিকায় ঢোকার আগেই সে দেশের সীমান্ত থেকে ১২ মিটার দূরে উদ্ধার হয় জগদীশ এবং তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের দেহ। মনে করা হয়, টরন্টোর কনকনে ঠান্ডায় (হিমাঙ্কের ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস নীচে) মৃত্যু হয় জগদীশদের।
তবে জগদীশ একা নন। তথাকথিত এই ‘ডাঙ্কি রুট’-এ প্রতি বছরই বলি হন বহু মানুষ। যাঁরা এই পথে শেষ পর্যন্ত তাঁদের স্বপ্নপূরণ করতে পেরেছেন, তাঁরা বলছেন ঝুঁকি কোনও এক জায়গায় নয়। ঝুঁকি পদে পদে!
বিদেশ যেতে চাওয়া ভারতীয় শরণার্থীরা কোন পথে কোন দেশে পৌঁছবেন, তা তাঁদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। পুরোটাই ঠিক করেন এঁদের বিদেশে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেওয়া এজেন্টরা।
এই এজেন্টরা আসলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মানব পাচার জালের সদস্য। যাঁর যে দেশে যোগাযোগ রয়েছে, সেখানেই তাঁরা নিয়ে যান বিদেশ যেতে ইচ্ছুক ভারতীয় শরণার্থীদের। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁরা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছবেন কি না, কতটা নিরাপদ হবে সফর, তা কেউ বলতে পারবেন না।
কিছু কিছু এজেন্ট দুবাই থেকে সরাসরি আমেরিকার সীমান্তে মেক্সিকোয় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন শরণার্থীদের। তবে সেখানে গ্রেফতার হওয়ার ভয় বেশি। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরণার্থীদের কলম্বিয়ায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কলম্বিয়াও আমেরিকার সীমান্তের কাছের দেশ।
কলম্বিয়া থেকে তাই শুরু হয় ভয়াবহ সফর। শরণার্থীরা সেখান থেকে প্রবেশ করেন পানামায়। পানামার জঙ্গল ড্যারিয়েন গ্যাপ জুড়েছে দু’টি দেশকে। কিন্তু এই জঙ্গল নরকের আর এক নাম। খুব কম মানুষই ডাকাত এবং হিংস্র জন্তুদের আক্রমণ এড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন।
আবার আমেরিকা আর মেক্সিকোর ৩১৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত ঘেরা রয়েছে ধারালো ব্লেড দেওয়া কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে। সেই বেড়া এক লাফে পেরোতে হয় শরণার্থীদের। না পারলেই জখম হবে শরীর। ঝুঁকি এড়াতে অনেকে তাই রিও গ্রান্ডে নদী সাঁতরে পার হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এখানেও ঝুঁকি প্রবল। রিও নদীর জল বিপদসীমার উপরে থাকে অধিকাংশ সময়ে। এর জলের স্রোতও সাঁতারের প্রতিকূল।
একটু ভাল থাকার খোঁজে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলি থেকে অবৈধ ভাবে বিদেশে যেতে গিয়ে মারা যান বহু মানুষ। তবু বন্ধ হয় না ‘ডাঙ্কি রুট’। বিপদ আছে জেনেও এই পথই বেছে নেন জগদীশরা।