ক্ষমতা পেলে এক দিনের মধ্যে বন্ধ করবেন যুদ্ধ। তাঁর হাত ধরেই নাকি আসবে বিশ্বশান্তি। নির্বাচনী প্রচারে দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি কার্যকর করতে নাকি ইতিমধ্যেই কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন তিনি। যা ‘চিরশত্রু’ রাশিয়ার মুখের হাসি চওড়া করেছে।
তিনি, আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পূর্ব ইউরোপের লড়াই থামাতে যাঁর শান্তি পরিকল্পনার নীল নকশা নিয়ে ইতিমধ্যেই দুনিয়া জুড়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে কোনও ঘোষণা করা হয়নি।
কী রয়েছে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায়? প্রথমত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যে এক জন আমেরিকান সৈন্যও পাঠানো হবে না তা স্পষ্ট করেছেন তিনি। পাশাপাশি, পূর্ব রণাঙ্গনে ইউরোপীয় সৈন্য মোতায়েন করতে চাইছেন এই রিপাবলিকান নেতা।
দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে প্রায় এক হাজার তিনশো কিমি লম্বা একটি বাফার জ়োন তৈরিতে জোর দিতে পারেন ডোনাল্ড। এত দিন পর্যন্ত মূলত আমেরিকার পাঠানো হাতিয়ারের ভরসাতেই যুদ্ধ লড়ছিল কিভ। কুর্সিতে বসেই তা বন্ধ করতে পারেন ট্রাম্প।
সংবাদ সংস্থা ‘দ্য টেলিগ্রাফ’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পের দলের এক সদস্য বলেছেন, ‘‘ইউক্রেনে শান্তি ফেরাতে আমরা আমেরিকার কোনও পুরুষ বা মহিলাকে সেখানে পাঠাচ্ছি না। আমরা এর জন্য কর দিই না। চাইলে ব্রিটিশ, ফরাসি, জার্মান বা পোলিশরা এটা করতে পারেন।’’
সূত্রের খবর, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউক্রেনে দখল করা জমি থেকে রুশ ফৌজকে পিছু হটতে হবে না। উল্টে রাশিয়ার ভিতরে যে জায়গায় ইউক্রেনীয় সেনা ঢুকেছে, সেখান থেকে সরতে হবে তাঁদের।
তবে এই শান্তি পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, আগামী ২০ বছরের জন্য নেটোর সদস্যপদ পাবে না ইউক্রেন। জ়েলেনস্কির দেশের নেটোর সদস্যপদ পাওয়া নিয়েই রাশিয়ার সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল। মস্কোর দখলে থাকা ক্রিমিয়াকে রুশ অন্তর্গত এলাকা বলেও মেনে নিতে পারে আমেরিকা।
ট্রাম্পের এ হেন ‘শান্তি সমঝোতা’ যে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির একেবারেই মনে ধরবে না, তা বলাই বাহুল্য। যদিও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের কথায়, আপাতত তা মেনে নেওয়া ছাড়া তাঁর কাছে অন্য রাস্তাও নেই।
কারণ, গত আড়াই বছর ধরে রাশিয়ার মতো শক্তিধর দেশের বিরুদ্ধে মূলত আমেরিকার হাতিয়ারের ভরসাতেই লড়ছিল ইউক্রেন। সেই অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হলে মস্কোর সঙ্গে এঁটে ওঠা কিভের পক্ষে এক রকম অসম্ভব বলেই মনে করছেন সমর বিশেষজ্ঞেরা।
আর তাই এই বিষয়টি আঁচ করেই কয়েক মাস আগে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে হওয়া একটি রাজনৈতিক সম্মেলনে ইউরোপীয় দেশগুলির সমর্থন আদায়ের মরিয়া চেষ্টা করেন জ়েলেনস্কি। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘রাশিয়াকে ছেড়ে দিলে ইউরোপের জন্য তা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে।’’
‘দ্য ডেলি মেল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই সম্মেলনে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট যুক্তি দেন, আমেরিকান সৈন্য না থাকলে বাফার জ়োনের নিরাপত্তার দায়িত্ব পড়বে ব্রিটেন ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের উপর। তখন আরও আগ্রাসী হবে মস্কো।
ট্রাম্পের শান্তি সমঝোতা নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন ব্রিটেনের নিরাপত্তা আধিকারিকেরা। তাঁদের কথায়, এতে ইউক্রেনের আঞ্চলিক বিভাজনের সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই প্রস্তাব রাশিয়াকে পুরোপুরি সুবিধা করে দেবে।
অন্য দিকে নিজের দেশের সোচিতে একটি নিরাপত্তা সম্মেলনে নেটোকে নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আমেরিকার নেতৃত্বের উপর এই শক্তিজোটের নির্ভরতাকে উপহাস করেছেন তিনি। তাঁর দাবি, ‘‘ওয়াশিংটন হাত তুলে নিলে নেটো আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখতে পারবে না।’’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতিতে নেটোর দুর্বল হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। ইউরোপের এই শক্তি জোটের জন্য ওয়াশিংটন কেন বিপুল টাকা খরচ করবে, তা নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে বার বার প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
তা ছাড়া দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এলে ইউরোপ ও এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। সেই লক্ষ্যে আমদানি শুল্ক কয়েক গুণ বৃদ্ধি করতে পারেন তিনি। যা চিন ও আমেরিকার সম্পর্ককে অন্য খাতে নিয়ে যেতে পারে। তার আগেই ইউরোপে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইছেন বর্ষীয়ান এই রিপাবলিকান নেতা।
আগামী বছরের (২০২৫) সালের জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ট্রাম্প। নির্বাচনে জেতার পর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন তিনি। সেখানে শান্তি সমঝোতা নিয়ে কোনও আলোচনা হয়েছে কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি।
তবে যুদ্ধ বন্ধ করতে আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যে রাস্তায় হাঁটতে চাইছেন, তা মোটেই কার্পেট বিছানো নয়। তাঁর শান্তি সমঝোতা ইউক্রেন মেনে না নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। তা ছাড়া ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলি কিভকে সামরিক সাহায্য দিলে সংঘর্ষ আরও লম্বা হতে পারে।
অন্য দিকে যুদ্ধ বন্ধ করতে যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য ওয়াশিংটনের উপর চাপ তৈরি করতে পারে রাশিয়া। মস্কোর সেই শর্ত ট্রাম্পের পক্ষে মেনে নেওয়া আদৌ সহজ নয়।
নেটোভুক্ত দেশগুলির মধ্যে রয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি। ট্রাম্পের শান্তি সমঝোতা পছন্দ না হলে পাল্টা ওয়াশিংটনের উপর চাপ দিতে পারে তারা। কোনও অবস্থাতেই নেটোকে দুর্বল করতে রাজি নয় এই তিন দেশ। যা ট্রাম্পের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
এ ছাড়া পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ বন্ধ হলে আমেরিকার পুরো নজর যে প্রশান্ত মহাসাগরের উপর এসে পড়বে, তা ভাল ভাবেই জানে চিন। আর তাই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য নেপথ্যে থেকে বেজিংয়ের উস্কানি দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলত, ট্রাম্পের শান্তি সমঝোতা আদৌ রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে পারবে কি না, তার উত্তর দেবে সময়।