এ যেন জ্বলন্ত টাইটানিকে বসে নৈশাহারের প্রস্তুতি! আসন্ন বিপদের তোয়াক্কা না-করে বিপজ্জনক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে গোঁ ধরে থাকা। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের এ হেন ভাবগতিক দেখে চরম বিপদের পূর্বাভাস দিলেন আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁর নীতিতে সবার একসঙ্গে ডোবার আশঙ্কা প্রবল বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।
তিনি, যুক্তরাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হতে চলা ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে যাঁর শপথ নেওয়ার কথা। ট্রাম্প জিততেই রকেট গতিতে ছুটতে শুরু করেছে আমেরিকার শেয়ার বাজার। এর ফলে সেখানে শুধুই বুদবুদ উঠছে বলে অর্থনীতিবিদদের থেকে সতর্কবার্তা এসেছে।
চলতি বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। গণনা শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প যে দ্বিতীয় বারের জন্য কুর্সিতে ফিরছেন, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। এর পরই জেটের গতিতে বেড়েছে বিটকয়েনের দাম। ট্রাম্প ক্রিপ্টো মুদ্রার বড় সমর্থক হওয়ায় এর দরের সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন বাজার বিশেষজ্ঞেরা।
প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ভোটে রিপাবলিকান নেতার জয়ের প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পড়তে বেশি সময় নেয়নি। সেখানে স্টকের সূচক বাড়তে বাড়তে সর্বকালীন উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে। সর্বাধিক লাভবানদের তালিকায় নাম রয়েছে ট্রাম্পের ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এর সদস্যপদ পেতে চলা ধনকুবের শিল্পপতি এলন মাস্কের সংস্থা ‘টেসলা’র।
শুধু তা-ই নয়, ট্রাম্প জেতার পর থেকে ডলার শক্তিশালী হয়েছে। ডলারের নিরিখে টাকার দাম প্রায় ৮৫ টাকায় নেমে গিয়েছে। ফলে চিন, ভারত ও জাপানের মতো দেশগুলি থেকে লগ্নি সরাচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এর জেরে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির শেয়ারের সূচকে বড় পতন লক্ষ করা গিয়েছে।
আমেরিকার বাজার যখন পকেট ভরিয়েই চলেছে, তখন অর্থনীতিবিদদের থেকে আসা সতর্কতায় লগ্নিকারীরা হতবাক। বাজার বিশ্লেষকদের দাবি, ট্রাম্প যে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, তা বাস্তবায়িত করতে গেলে ডুববে আমেরিকার অর্থনীতি। সেই সঙ্গে ফেটে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজারের যাবতীয় বুদবুদ।
ওয়াশিংটনের উপর আর্থিক সঙ্কট নেমে আসার নেপথ্যে মূলত দু’টি কারণকে চিহ্নিত করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। প্রথমত, ডলারের প্রভুত্ব শেষ করতে নতুন মুদ্রা আনার পরিকল্পনা রয়েছে ভারত, রাশিয়া, চিন ও ব্রাজ়িলের মতো ‘ব্রিকস’ দেশগুলির। ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি, সে ক্ষেত্রে এই সমস্ত রাষ্ট্রের উপর ১০০ শতাংশ আমদানি শুল্ক চাপাবেন তিনি।
আর এইখানেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের যুক্তি, আমেরিকা আমদানি শুল্ক আকাশছোঁয়া করলে পাল্টা এই সমস্ত দেশও তা বৃদ্ধি করবে। ফলে ওই রাষ্ট্রগুলিতে পণ্য বিক্রি করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বেশ কঠিন হবে। আর তখনই হু হু করে পড়বে আমেরিকার সংস্থাগুলির স্টকের দর।
দ্বিতীয়ত, ভোটপ্রচারে ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতিতে জোর দিয়েছেন ট্রাম্প। আগামী দিনে বিদেশ থেকে আমদানি করা যাবতীয় পণ্য নিজের দেশে তৈরির কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। শুনতে লাভজনক বলে মনে হলেও এতে দু’টি সমস্যা রয়েছে। আমদানি করা যাবতীয় পণ্য তৈরির পরিকাঠামো নির্মাণ এবং শ্রম আইনের কড়াকড়ি।
উদাহরণ হিসাবে মাস্কের ব্যাটারিচালিত গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা টেসলার কথা বলা যেতে পারে। এর মূল কারখানা রয়েছে চিনে। রাতারাতি সেই কারখানা আমেরিকায় সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম আইন অনুযায়ী গাড়ি নির্মাণকারী শ্রমিকদের অনেক বেশি অর্থ দিতে হবে টেসলাকে।
ফলে এত দিন কম দামে যে গাড়ি মাস্কের সংস্থা তৈরি করতে পারছিল, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতি মানতে গিয়ে প্রথমেই তা ধাক্কা খাবে। ফলে এক ঝটকায় অনেকটা বেড়ে যেতে পারে এর দাম। দর বৃদ্ধির জেরে ক্রেতা কমার আশঙ্কা বাড়বে। পাশাপাশি, এ ভাবে প্রতিটা পণ্যের দাম বাড়লে আকাশছোঁয়া হবে মূল্যবৃদ্ধির সূচক।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে চিনা সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘গ্লোবাল টাইমস্’। সেখানে বলা হয়েছে, বেজিংয়ের সঙ্গে শুল্ক-যুদ্ধ শুরু হলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে ওয়াশিংটনের মূল্যবৃদ্ধির সূচক। বর্তমানে আড়াই থেকে তিন শতাংশের মধ্যে এটি ঘোরাফেরা করছে। ট্রাম্পের নীতিতে এক লাফে তা সাত থেকে আট শতাংশে পৌঁছতে পারে।
এ ছাড়া আরও একটি সমস্যার জায়গা রয়েছে। উন্নত অর্থনীতির দেশ হওয়ায় ভারতীয় সংস্থার থেকে তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা নিয়ে থাকে আমেরিকা। শুল্ক বৃদ্ধিতে এ দেশের সংস্থাগুলি ব্যবসা মার খেলে, আরও বেশি করে ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ার দিকে মুখ ঘোরাবে তারা। সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তি বিপ্লব ঘটিয়ে বিশ্বে প্রথম স্থান ধরে রাখা আমেরিকার পক্ষে কঠিন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৪০ শতাংশ চিন, কানাডা এবং মেক্সিকোর উপর নির্ভরশীল। হঠাৎ করে এই তিন দেশ থেকে পণ্য আসা বন্ধ হলে বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের সামঞ্জস্য নষ্ট হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হবে। এতে আমেরিকার ভিতরে জিনিসপত্রের দাম আগুন হওয়ার প্রভূত আশঙ্কা রয়েছে।
আমেরিকার স্টক মার্কেট তিনটি ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল। সেগুলি হল পরিষেবা, শিল্পোৎপাদন এবং কৃষি ও খনিজ উত্তোলন। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ট্রাম্পের নীতিতে পরিষেবা এবং শিল্পোৎপাদন দু’টি ক্ষেত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আর তাই শুল্ক বৃদ্ধির নীতিকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যেই সমালোচনার মুখে পড়েছেন নতুন প্রেসিডেন্ট।
এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার চিন্তা বাড়িয়েছে বন্ধু দেশ ফ্রান্স। ডলারবিহীন অর্থনীতিতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে প্যারিস। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ফরাসিদের দেখাদেখি আগামী দিনে একই রাস্তায় হাঁটতে পারে জার্মানিও। সে ক্ষেত্রে একের পর এক উন্নত দেশের সঙ্গে শুল্ক-যুদ্ধে নামা মূর্খামি হবে বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা।
আর্থিক দিক থেকে বিশ্বের প্রথম ১০টি দেশের তালিকায় নাম রয়েছে ভারত, ব্রাজিল, চিন, রাশিয়া এবং ফ্রান্সের। ট্রাম্পের গোয়ার্তুমি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমেরিকাকে একা করতে পারে। তখন আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে পড়লে অন্যের থেকে সাহায্য পাওয়ার রাস্তা বন্ধ হবে। যেটা কখনওই চাইবে না ওয়াশিংটনের সাদা বাড়ি (হোয়াইট হাউস)।
বিশ্ব জিডিপির ২৩ শতাংশে রয়েছে আমেরিকার দখল। দুনিয়ার যাবতীয় স্টকের ৭০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। ফলে সেখানে শেয়ারের গ্রাফ নামলে তার প্রভাব শুধু আটলান্টিকের তীরেই আটকে থাকবে এমনটা নয়, ভারতও লোকসানের মুখে পড়তে পারে বলে মিলেছে সতর্কবার্তা।