আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইতিহাস গড়লেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বুথফেরত সমীক্ষার যাবতীয় হিসাব বদলে দ্বিতীয় বারের জন্য কুর্সিতে বসছেন তিনি। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির দুধসাদা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে (পড়ুন হোয়াইট হাউস) ফের পা রাখার ক্ষেত্রে ১৩২ বছর আগেকার রেকর্ড স্পর্শ করলেন এই ধনকুবের রিপাবলিকান রাজনীতিক।
এ বারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী তথা বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সঙ্গে ট্রাম্পের লড়াই ‘কাঁটে কা টক্কর’ হতে চলেছে বলে মনে করেছিল রাজনৈতিক মহল। ভোট শতাংশের নিরিখে তাঁরা একে অপরের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলবেন বলে পূর্বাভাস মিলেছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
চলতি বছরের ৬ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণা হতেই দেখা যায়, প্রতিপক্ষকে রীতিমতো উড়িয়ে বিপুল ব্যবধানে জিতেছেন ট্রাম্প। আমেরিকার ভোটে প্রার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণে ‘দোদুল্যমান রাজ্য’গুলি (সুইং স্টেট) বড় ভূমিকা নিয়ে থাকে। এ বারের নির্বাচনে সাতটি সুইং স্টেটেই বিজয়ী হয়েছেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। যা আমেরিকার নির্বাচনে বিরল ঘটনা।
২০১৬ সালে প্রথম বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ট্রাম্প। সে বার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের স্ত্রী হিলারি ছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী। ওই বছরেও বুথফেরত সমীক্ষায় পিছিয়ে ছিলেন ডোনাল্ড। নির্বাচনে ভোট কম পেলেও সব হিসেব উল্টে দিয়ে কুর্সি দখল করেন তিনি।
কিন্তু চার বছরের মধ্যেই জনপ্রিয়তা হারান ট্রাম্প। ২০২০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে হেরে যান তিনি। পরাজিত হয়েও রাজনীতির ময়দান ছাড়েননি তিনি। বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে নানা ইস্যুতে আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছেন ডোনাল্ড। যার ফসল এ বছরের নির্বাচনে তুললেন প্রবীণ এই আমেরিকান রাজনীতিবিদ।
এ বারের ভোটে জিতে ১৩২ বছর আগের গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের রেকর্ড স্পর্শ করলেন রিপাবলিকান প্রার্থী। আমেরিকার ২২ ও ২৪তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন নিউ ইয়র্কবাসী এই ডেমোক্র্যাট রাজনীতিবিদ। চার বছর কুর্সিতে থাকার পর হেরে গিয়ে ফের নায়কের মতো সাদা বাড়িতে প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল তাঁর।
১৮৮৪ সালে খুব অল্প ভোটে জিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ক্লিভল্যান্ড। চার বছর পর জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট (পপুলার ভোট) অনেক বেশি পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, তা সত্ত্বেও ১৮৮৮ সালের নির্বাচনে হেরে যান ক্লিভল্যান্ড। এর পর নিজেকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন এই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী।
ক্লিভল্যান্ড রাজনীতি থেকে সরে গেলেও আমজনতার মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা কমেনি। ১৮৯২ সালে একরকম জোর করেই ফের তাঁকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী করে ডেমোক্র্যাটরা। পুনরায় ভোটের ময়দানে নেমে প্রতিপক্ষকে একরকম উড়িয়ে দেন তিনি। ফলস্বরূপ রিপাবলিকান প্রার্থী বেঞ্জামিন হ্যারিসনকে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়।
ক্লিভল্যান্ডের সেই রেকর্ডই এ বার ছুঁয়ে ফেললেন ট্রাম্প। মজার ব্যাপার হল, ২০২০ ও ২০২৪— দু’বারই মহিলা প্রার্থীর বিপক্ষে লড়েছেন তিনি। প্রথম বার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন হিলারি ক্লিন্টন। এ বার কমলা হ্যারিসকে হারিয়েছেন ডোনাল্ড। যা তাঁর পূর্বসূরি ক্লিভল্যান্ডের ক্ষেত্রে হয়নি।
আমেরিকার ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত সর্বাধিক বয়স্ক প্রেসিডেন্ট হলেন জো বাইডেন। এ বছরের ২০ নভেম্বর ৮২ বছরে পা দেবেন তিনি। দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর বয়স ৭৮। ২০২০ সালে প্রথম বার নির্বাচিত হওয়ার সময়ে তিনিই ছিলেন সর্বাধিক বয়স্ক প্রেসিডেন্ট।
প্রথম বার কুর্সিতে থাকাকালীন দু’বার ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হন ডোনাল্ড। তাঁর আগে আমেরিকার কোনও প্রেসিডেন্টকে দু’বার এই নোটিস ধরানো হয়নি। যদিও ‘কংগ্রেস’-এর (আমেরিকার পার্লামেন্ট) উচ্চকক্ষ সেনেট তাঁকে বেকসুর বলে ঘোষণা করে।
২০১৯ সালে প্রথম বার ইমপিচমেন্টের মুখে পড়েন ট্রাম্প। ওই সময়ে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে গোপনে ইউক্রেনের কাছে সাহায্য চাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। ২০২০ সালের ভোটে কে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন, তা আগেভাগে জানতে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে নাকি তদন্ত করতে বলেন ডোনাল্ড।
ইউক্রেনকে ৪০ কোটি ডলারের সামরিক সাহায্য দেওয়ার কথা ছিল আমেরিকার। কিন্তু তা আটকে দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। পরবর্তীকালে অবশ্য রাশিয়া ওই পূর্ব ইউরোপের দেশটিকে আক্রমণ করলে কোটি কোটি টাকার হাতিয়ার দিয়ে সাহায্য করতে থাকে বাইডেন প্রশাসন। যার কড়া সমালোচক ছিলেন ডোনাল্ড।
২০২০ সালের ভোটে বাইডেনের কাছে পরাজিত হলেও হার স্বীকার করতে চাননি ট্রাম্প। নিয়ম মেনে হোয়াইট হাউস ছাড়তে নারাজ ছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, ট্রাম্পের গোঁড়া সমর্থকদের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি রাজধানী ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলে হিংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে। ফলে মেয়াদ শেষের এক সপ্তাহ আগে ফের ইমপিচমেন্টের মুখে পড়েন তিনি। সেই নোটিসের তারিখ ছিল ২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি।
এ বছরের মে মাসে তথ্য গোপনের উদ্দেশ্যে ব্যবসায়িক নথি জালিয়াতির মামলায় ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন আদালত। আগামী ২৬ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণা করতে পারে সংশ্লিষ্ট আদালত। তিনিই একমাত্র আমেরিকান প্রেসিডেন্ট, যাঁকে ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ওঠা মোট ৩৪টি অভিযোগের সব ক’টিই প্রমাণিত হয়েছে বলে জানিয়েছে ম্যানহাটন আদালতের ১২ সদস্যের জুরি। প্রথমে ১১ জুলাই সাজা ঘোষণার দিন ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু ডোনাল্ড প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার আবেদন জানানোয় তা পিছিয়ে দেয় আদালত। পরে ১৮ সেপ্টেম্বরও সাজা ঘোষণা স্থগিত রাখা হয়।
প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে পর্নতারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও রয়েছে। যা জানাজানি হলে নির্বাচনী ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করেন ডোনাল্ড। আর তাই ২০১৬ সালে ভোটের মুখে বন্ধ রাখতে স্টর্মিকে ১ লক্ষ ৩০ হাজার ডলার ঘুষ দিয়েছিলেন তিনি। এমনটাই দাবি তুলেছিলেন ম্যানহাটন ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি তথা ডেমোক্র্যাট সদস্য অ্যালভিন ব্র্যাগ।
টাকা দেওয়ার বিষয়টি গোপন রাখতে ট্রাম্প তাঁর ব্যবসায়িক সংস্থার নথিপত্রে জালিয়াতি করেন বলে আদালতে মামলা দায়ের হয়েছিল। যা প্রথম থেকেই অস্বীকার করে এসেছেন ডোনাল্ড। অভিযোগকারী ডোমেক্র্যাট সদস্য হওয়ায় তিনি ‘রাজনৈতিক চক্রান্তের’ স্বীকার বলেও ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিলেন রিপাবলিকানেরা।